ভূত আমার…

রাজশেখর বসু— পরশুরাম তাঁর ‘ভুষণ্ডির মাঠ’-এ নানাধরনের ভূতুড়ে চরিত্র এনেছেন। তারা বেশ রসেবশে থাকা ভূত। তাদের মধ্যে একটি চরিত্র ‘কারিয়া পিরেত’। ‘ভুষণ্ডির মাঠ’ আর ‘লম্বকর্ণ পালা’ নাটক হিসাবেও খুব জমেছিল একসময়। ভুষণ্ডির মাঠ-এ ভূতেদের, পেত্নীদের প্রেম কাহিনি, বিরহ— তাও তো বেশ মজারই। আপাতত সেইসব কথা শিকেয় তুলে রেখে আমরা বরং ‘জলার পেত্নী’, ‘নারকেলমুখী’ এদের কথা বলি। ‘কানাহোলা’ বা ‘ভুলো ভূত’ তো কী কী বজ্জাতি, বদামি করতে পারে, তার কথা তো বিস্তারিতভাবে বলা দরকার। ‘কানাহোলা’ নাকি বেহুদা-বেশরম বাতাস হয়ে ভরা দুপুরবেলা পথিককে ‘টালায়’। এই ‘টালানো’ বা ‘টালায়’ শব্দটা একেবারেই খোড বা খাস পূর্ববঙ্গের। ‘ভূতে টালায়’— এরকম একটা শব্দও খুব ঘুরে বেড়াত ঢাকা-ফরিদপুরে। জলার পেত্নী, শাঁকচুন্নি, ‘নারকেলমুখী’— সবাই কিন্তু টালায়। ‘ঠিক দুক্কুরবেলা/ ভূতে মারে ঢেলা’— চার লাইনের এই ছিকুলিটি এ-বঙ্গে— পশ্চিমবঙ্গে খুবই প্রচলিত, নানা লেখায়, গল্পে, গপপেই তো ঠিক ‘দুক্কুরবেলা…’। এমনকি সনৎ সিংহর একটি গানেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে, একটি অন্যরকমভাবে। গানের লাইনটা হল— ‘ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢিল/ ঢিল ন্য ঢিল নয়, শিল শিল শিল…’। ‘শিল’ বলতে এখানে শিল-নোড়ার শিল নয়। আকাশ থেকে পড়া বরফ কুচি, কখনও ঢিল কখনও বা ঢেলার সাইজ। যাকে সাদা বাংলায় বলে শিলাবৃষ্টি। আর একটু শুদ্ধ বাংলায় বলা হয়ে থাকে করকাপাত। তো ‘কানাহুলো’, ‘ভুলোভূত’, ‘ভূতে টালানো’— সবই তো এল পরপর। আর ভূতেদের— মানে ‘তেনাদের’, রাতে— রাত-বিরেতে যাদের নাম করতে নেই, আর করলেও ‘রাম রাম রাম রাম’ বলতে হয়, সেই যে তেনারা— যাদের কেউ কেউ বেলগাছে বা তালগাছে বসে থাকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে, কখনও এক ঠ্যাং, কখনও বা দুই ঠ্যাং আর সব কথা— বাক্য-শব্দের মাথায় চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে কথা বলে থাকে, খোনা বা খনা গলায়, সেইসব ‘তেনাদের’, রাতে যাদের নাম করতে নেই, তাদের সবার গোড়ালি নাকি উল্টোদিকে ঘোরানো আর একেবারেই কোনো ছায়া পড়ে না তাদের। ছোটোবেলায় একটা ছড়া আমরা খুব সুর করে করে বলতাম।

‘ভূত আমার পুত
পেত্নী আমার ঝি
রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে
করবি আমার কী?’

ব্যস, তাতেই নাকি ভূত-প্রেত— পিরেত— সব্বাই পালিয়ে যাবে। এমনকি রাতে শোয়ার সময় মাথার মালিশের ওয়ারের গায়ে ‘রাম রাম রাম রাম’— এই করে তিনবার রাম নাম লিখলেই নাকি ভূত-প্রেত, দুষ্ট আত্মা, পিশাচ, সব পগার পার। গ্রামের দিকে প্রচলিত কথায় আছে, বিশ্বাসও করেন, করতেন অনেকে— মোষেরা নাকি আত্মা, ভূত দেখতে পায়। আর দেখতে পায় কুকুরেরা। কুকুরের কান্নায় নাকি অমঙ্গল বেজে ওঠে। মৃত্যু-আস্নন, মৃত্যু বিষয়ে সতর্ক করে কুকুর-কান্না। তাই সারমেয়-ক্রন্দনকে অনেকেই ভয় পান, আতঙ্কিত হন, সেই কান্না শ্রবণ করে। এদিকে আবার কথায় আছে— তোর মরণে— তোর দুঃখে শেয়াল-কুকুরও কাঁদবে না। কলকাতায় একসময় ‘ভূতের বাড়ি’, ‘হানাবাড়ি’— এইসব দেখা যেত। আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরি— জাতীয় গ্রন্থাগারের আশপাশে নাকি ভূ-ভূ-ভূ-ভূত। ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ। ছায়া ছায়া— ছায়ামূর্তি। ‘আকাশবাণী’-তেও নাকি ছায়া ছায়া ছায়াময়, ছায়াময়ীরা। বাগবাজারে ‘যুগান্তর’-‘অমোত্তোবাজার’ বা ‘অমেত্তোবাজার’— অমৃতবাজার পত্রিকা মূলত উত্তর কলকাতার সাধারণ জনের মুখে মুখে যা হয়েছে, সেই বাড়িতেও— বাগবাজারের বাড়িতেও নাকি ভূত আর ভূত। একতলা, দোতলা, তিনতলা সর্বত্র। কলঘরে, চানঘরে, পায়খানায়— ভূত ভূত হিকেবলম। আর সেখানে কোনো ভূত শিকারি ‘বড়ো কত্তা’, ‘মেজোকত্তা’, ‘ছোটো কত্তা’ নেই। ‘মহাত্মা’ শিশিরকুমার ঘোষের ভূতছায়া নাকি ঘুরে ঘুরে বেড়ায় অমেত্তোবাজার পত্রিকা অফিসের আনাচে-কানাচে। আকাশবাণী— রেডিও স্টেশনের পুরনো বাড়ি গার্স্টিন প্লেসে নাকি ছিল ভূত, ভূত আর ভূত। কলকাতার বেলভিডিয়ার-এর রাস্তায় রাস্তায়, খিদিরপুর ডক আর তার কাছাকাছি ছায়া কালো রহস্য। ছমছমে ভাব। আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগার— ন্যাশনাল লাইব্রেরি, তার আশেপাশেও নাকি তেনারা। তবে তারা বেশিরভাগই সাহেব ভূত— নাহ্ গবলিন নয়, নয় হ্যালুইন রাতের কোনো চূর্ণ কায়া-মায়া ক্রুদ্ধ প্রেত। বরং তারা সব কোম্পানি— ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমল বা তার একটু পরেকার ইংরেজ। ইংরেজ— ইংরেজই, ডুয়েল লড়া, পিস্তল বাজানো, ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দে ছিন্ন হয় চারপাশের স্থির ও অস্থির নীরবতা। ঘোড়ার পাশের শব্দ— ট্রলপ ট্রলপ— ট্রলপ ট্রলপ, ঘোড়ার খুরের নিজস্ব বাদন, রহস্যময়তা— ভূত আর ভূতের গপপো— জাতীয় গ্রন্থাগার— ন্যাশনাল লাইব্রেরি ঘিরে— অনেক অনেক ভূত ও ভূতো। তখন কলকাতায় ডেভেলপার, প্রোমোটাররা নেই। থাকা সম্ভবও নয়। তাই প্রতি পাড়াতেই প্রায় হানাবাড়ি। সেখানে ভূতের খেলা, ভূতের মেলা, ভূতের আসর। ভূতের জলসা। ভূতের মজলিশ। রাস্তায় রাস্তায় তখন আলো নেই। তারপর তো এল টিমটিমে গ্যাসের বাতি। আলো যত জোরালো হয়, ভূত ততই দূরে পালায়, ভূতেরা আলো সহ্য করতে পারে না একেবারেই। অন্তত ভূতেদের নিয়ে গপপো-গাছা তো বলে যেতে থাকে তেমন কথাই। ‘ভূত তাড়ানো’, ‘ভূত ছাড়ানো’ এসব দেখেছি নিজের চোখে। ওঝা, গুনিনদের নিজস্ব কেরদানি বা ক্যারদানি, ফুঁকফাঁক। ওঝাদের রোজা বলার রেওয়াজও দেখেছি গ্রাম বাংলার কোথাও কোথাও। বাংলা মুলুকে যা পেত্নী— হিন্দি বলয়ে তাদের নামই তো চুড়েল বা চুড়েয়েল। বাংলায় ‘পেত্নী’, ‘ভূত’ যেমন একসময় মৃদু গালাগালি ছিল, ‘চুড়েল’ বা ‘চুড়েয়েল’-ও তাই গোবলয়ে বা হিন্দিবলয়ে। এখন— ইদানিং বেশ কয়েক বছর হল গালি হিসাবে আর ‘ভূত’, ‘পেত্নী’ শুনি না। সিনেমা, সিরিয়ালের দৌলতে ‘চুড়েল’ বা ‘চুড়েয়েল’ কিন্তু গাল হিসাবেই রয়ে গেছে। আমি নিজে নানা জায়গায় ‘ওঝা’ বা ‘রোজা’— গুনিনদের ভূত তাড়ানোর ক্রিয়াকলাপ দেখেছি। দেখেছি বলতে একেবারে সামনাসামনি, প্রত্যক্ষদর্শী যাকে বলে, একেবারে সামনাসামনি দেখা। তো সেই বিবরণ দেব। তার আগে বলি ইলাহাবাদের পুরানা কাটরার— আমার মায়ের জাঠতুতো দিদি— রেণু ভট্টাচার্যের বাড়ির সামনে যে গলি পথ, আবার সেই গলিপথই রাজপথ হয়ে মিশে গেছে আহির— যাদবদের বাসস্থান পরেটের— খানিকটা ফাঁকা মাঠ সহ কয়েকটা বাড়ি— সেখানে ‘কৃষ্ণ ভগবানের বংশোধর’ বলে দাবি করা যাদব-গোয়ালা-আহিররা থাকেন। তো তাঁদের পদবি যাদব। ওঁরা মুখে মুখে যাদবকে ‘যাদো’ বা ‘য়াদো’ বলে। তো সেই ফাঁকা— শষ্পহীন— ঘাসবিহীন— তৃণহীন ফাঁকা জমিতে গরু-মোষ-ছাগলও থাকে বাঁধা। আহিররা— যাদো, য়াদোরা বকরা-বকরি ছাগল, পাঁঠা-খাসি প্রায় পোষেন না। ছাগল পোষেন মূলত পাশিরা, কাহাররা। পাশিদের পদবি পাশি। পুরানা কাটরার গা লাগোয়াই পাশিয়ানা। 

আসলে ভূত-পেত্নী, বেহ্মদত্তি বা ব্রহ্মদত্যি— ব্রহ্মদৈত্য, গন্নাকাটা, শাঁকচুন্নি, নারকেলমুখী, জলার পেত্নী, স্কন্ধকাটা, মামদোভূত, সাহেব বা সায়েব ভূত, গবলিন, পেঁচো, ইত্যাদি প্রভৃতিদের প্রসঙ্গে আসা এই জন্য, সেই যে ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা বা পুরানা কটরার— স্থানীয় জিভে এমনকি ইলাহাবাদ প্রবাসী বাঙালিদের উচ্চারণেও পুরানা কাটরা হয়ে ওঠে পুরানা কটরা, তো সেই পুরানা কাটরা বা পুরানা কটরায় আমার ঢুকে পড়ার রাস্তাটি এরকম। কাছারি— হাইকোর্ট— ইলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে সো-ও-জা বড়ো রাস্তা ধরে চলে এসে ডান দিকে মোড় নিলেই পুরানা কাটরা বা পুরানা কটরা। ঢুকেই ডানদিকে তিরথ-এর স্পিরিটের দোকান, লোকাল ডায়লেক্টে ইস্পিরিট। এই স্পিরিটে বোতলের গায়েই কঙ্কালমুখ— করোটি। তখনও স্পিরিট ল্যাম্প পাওয়া যায় বাজারে। সেই স্পিরিট ল্যাম্প দিয়ে অনেক অনেক জরুরি কাজ সারেন গৃহস্থ। মিথিলেটেড স্পিরিট ঢেলে স্পিরিট ল্যাম্পের বুকে রাখা তারের জালির নিচে যেটুকু পলতে জাতীয় জিনিস, তা ভিজিয়ে তারপর দেশলাই কাঠি— দীপশলাকা কারলেই নীলচে শোভন আলো। সেই অগ্নিশিখায় বাচ্চার দুধ গরম, চায়ের জল গরম ইত্যাদি প্রভৃতি ছয়ের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তর ঘরে স্পিরিট ল্যাম্প। এই জল গরম, দুধ গরম প্রসঙ্গে মনে পড়ল তখন দীপ্তেন্দ্র সান্যাল— দীপ্তেন সান্যাল নামেই বেশি পরিচিত, তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘অচলপত্র’-র গায়ে, মানে প্রথম পাতায় যে ফণীমনসার অঙ্কন ছাপা হত, যেমনভাবেই  ‘বড়োদের পরিবার, ছোটোদের দুধ গরম করিবার…’ ইত্যাদি প্রভৃতি ছাপা হত। ‘অচলপত্র’-কে এই পত্রিকার ঘনিষ্ঠজনেরা ছাড়াও অনেকেই বলতেন ‘অচল’। ‘অচলপত্র’-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন কবি, সাংবাদিক, ঐতিহাসিক, পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির দৌহিত্র বংশজাত কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কল্যাণদার কাছে শুনেছি ‘অচল’-এর নানা কাহিনি। দীপ্তেন সান্যালের ঝকঝকে, ‘শর্ট বাংলা গদ্য’, গান ছিল মনে রাখার মতো। যাকে কল্যাণদা ‘দীপ্তদিয়ানা’ বলতেন। দীপ্তেন সান্যাল দীর্ঘ জীবন পাননি। আর এক গুণীজন, সাংবাদিক-লেখক প্রাণতোষ ঘটক-ও না। প্রাণতোষ ঘটক মাসিক বসুমতীর সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। হৃদয়বান, গুণীজন, কথাকার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি ‘প্রাসাদপুরী কলকাতা’ লেখান। প্রেসিডেন্সি কলেকে রমাপদ চৌধুরী ছিলেন তাঁর সহাধ্যায়ী। প্রাণতোষ ঘটকও অকাল প্রয়াত, যেমন দীপ্তেন সান্যাল— দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল। ইলাহাবাদের পুরানা কাটরা থেকে মনমোহন পার্ক, হাথিপার্ক, আনন্দভবন যাওয়ার যে রাস্তা, ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি যাওয়ার যে রাস্তা, তা চোখের সামনে বার বার বার বার ভেসে ওঠে। যতদূর জানি ইলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে মিলিটারি সায়েন্স— রণবিজ্ঞান পড়ানো হত সাতের দশকেও। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার মিনারটি ছিলেন দেখার, দূর থেকে যা চোখে পড়ত। এখনও নিশ্চয়ই পড়ে। তো পুরানা কাটরায় বরো মাসি— রেণু ভট্টাচার্য, মেসোমশাই আর ভট্টাচার্য বাড়ি। তখনও ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র ইলাহাবাদ এডিসনের নাম ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা’। পত্রিকাবাড়ি, পত্রিকা অফিস— এমনই তো বলা হত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র বাড়িকে। আমার মেসোমশাই আশুতোষ ভট্টাচার্য ছিলেন অমৃতবাজার পত্রিকার লাইনো অপারেটর। পরে তিনি ‘নর্দার্ন ইন্ডিয়া পত্রিকা’-র লাইনো অপারেটর হয়ে যান। খুবই ভালো মানুষ। চমৎকার আদর-আপ্যায়ন করতেন সবাইকে। লোকজন, তাঁর বাড়িতে আত্মীয়স্বজন, কুটুম এলে তিনি ও বড়োমাসি— দুজনেই কী যে খুশি হতেন। তো এই বাড়ির ভেতরই তিরথের স্পিরিটের দোকান। এ স্পিরিট দিয়েই— স্পিরিট পান করেন রিকশাওয়ালারা। ত্বরান্বিত করেন নিজেদের মৃত্যু। এই গলির মধ্যেই— তিরথের স্পিরিটের দোকানের পরই বাঁদিকে মিশ্রা কোম্পানি— আংরেজি হাওয়াখানা। এই মিশ্রাজির দুটি কন্যা। বড়োটি লোকাল লওন্ডারা ‘ঘড়ি’ বলে ডাকে— নিজেদের ভেতর। ছোটোটি সবিতা। সবিতা আমার বড়ো মাসির ছোটো মেয়ে কুক্কু— লীনার সঙ্গে এক ক্লাস, এক স্কুলে পড়ে। স্কুলের নাম ওয়ার্নামেকার। মিশনারি স্কুল। সেই বিদ্যায়তনের শিক্ষক ছিলেন মিস বেলি, মিস চরণ। এই গলির বাঁদিকেই তিনজন পাগল পণ্ডিতের বাস। যাদের মূল কাজ নিজেদের বাড়ির দোতলায় অন্ধকার করে দিয়ে বসে থেকে হঠাৎ হঠাৎ গলি দিয়ে যাতায়াত করা পাবলিকের দিকে অকারণে ইটা-পাথর চালানো। তা থেকে অ্যাকসিডেন্টও তো হয়েছে কতবার। কোতোয়ালি— থানা— পুলিশস্টেশন থেকে কতবার যে পুলিশ এসেছে, ধরে নিয়ে গেছে এই অন্ধকারে বসে বসে আচমকা ইটা-পাথর— ইট-পাথর বর্ষণ করা তিন ভাইদের। আবার থানা বা জেল থেকে বেরিয়েও এসেছে তারা একে একে, কী এক কৌশলে। তারপরই তো এক আহিরিন— গোয়ালাঘরের বধূ। তাঁকে তো বদ্রি কুমার, ওয়াহিদা বলে ডাকতেন আড়ালে। বদ্রি চামার শ্রেণীর। সামান্য ট্যারা— লোকাল ল্যাঙ্গোয়েজে ‘ফুত্তু’। বদ্রি আর রামু— রামু সিং, তাঁর আসল বাড়ি এটাওয়া— ইটাওয়া বা এটা। রামুর মুখশ্রী অনেকটা যেন অভিনেতা দিলীপকুমারের। তবে হাইট তো অত নয়। রামু ইলাহাবাদে এজি অফিসে চাকরি করত। বেশিরভাগ সময় পায়জামা আর হাফ শার্ট। বদ্রির মাথায় চুল পাকা, কৃষ্ণবর্ণ। পাকা চুলে কোলগেট তেল মাখে বদ্রি। নাকের নিচে শখদার গোঁফ। রামু, বদ্রি— দুজনেই রেণু মাসি আর আশুতোষ মেসোমশাইয়ের তিন ছেলের সবচেয়ে ছোটো অশোক ভট্টাচার্য— বাবুর বন্ধু। রামু, বদ্রি- দুজনেই বাবুদার হলায়-গলায় বন্ধু। রেণু মাসির বড়ো ছেলে খোকন— আদরের ডাকে মক্কু— রঞ্জিত ভট্টাচার্য, মেজো দিলীপ ভট্টাচার্য ডাক নামে বেড়ু। তারপর তিন মেয়ে মঞ্জু— বুড়ি, রঞ্জনা— মানু, লীনা— কুক্কু। রেণু মাসি— বড়ো মাসি যাকে অতি আদর করে কোক্কা বলে ডাকতেন। বড়ো মাসির বাড়ি তিরথের স্পিরিটের ডুকান থেকে খানিকটা মানে মিনিটখানেক এলেই ডানদিকে।  ৮৫৩/৭৩২-এর উল্টোদিকে খারেদের বাড়ি। খারে সেখানে থাকেন, এক যবনীর প্রেমে বাঁধা পড়ে। সেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী নারীর প্রেমে থাকা খারে। খারে হল পদবি— উত্তরপ্রদেশের কায়স্থ। খারে, শ্রীবাস্তব— এঁরা সবাই ইউপি-র কায়েত— কায়স্থ। এই নারীর পুত্র মুন্নু। মুন্নু সামান্য ল্যাংড়া— অপাহিজ, প্রচুর মদ খায়। আর দারু পিয়া করলেই তখন মাথায় এসে বসে পড়ে দুষ্টু কিছু একটা। দারু পিকে বওয়ায় মুন্নু। প্রচুর খিস্তিখাস্তা— গালি বকা। গালি দেওয়া। মুন্নুর বোন মুন্নি। তার বিবাহ হয়েছে কট্টন নামে এক সমাজবিরোধীর সঙ্গে। কট্টন পারতপক্ষে কারও সঙ্গেই কোনো কথা বলে না। টেরিকটের ফুলপ্যান্ট, ওপরে হাতা গোটানো ছাই রঙের ফুলশার্ট। মাথা সব সময় নিচু। মাথা ভর্তি কালো চুল ‘ব্রিল ক্রিম’ দিয়ে টেনে ব্যাকব্রাশ করা। তখন ব্রিল ক্রিমের বিজ্ঞাপন করেন ভারতীয় ক্রিকেটার অতি হ্যান্ডসাম উইকেট কিপার ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ফারুক দারুণ উইকেট কিপার। স্টাম্পিং বিশারদ। ফারুকের পর আর একজন ইউকেট কিপার— ওপেনার ব্যাটসম্যান ইন্ডিয়ান টিমে— বুধি কুন্দরন। ফারুক ইঞ্জিনিয়ার খুব হ্যান্ডসাম। খুব ভালো উইকেট কিপার। দারুণ মারকুটে ব্যাটসম্যান। তাঁর টেস্ট কেরিয়ারের প্রথম দিকে ফিফথ ডাউন, সিক্সথ ডাউন, পরে ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসাবে চলে এলেন। তখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক পতৌদি। পতৌদির নবাব— নবাব মনসুর আলি পতৌদি। এক চোখ নিয়ে কি খেলাটাই না খেলে গেলেন নবাব। নবাব পতৌদি। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সর্বোচ্চ রান ২০৩, নট আউট ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ইংল্যান্ড দল তো এক সময় অনেক স্বপ্ন বুনেছিল। এই গলির ভেতরই তো ছোটে নাউ তার প্রেমিকা মেথরানিকে, অতি গন্ধময় জীবনকে নিয়ে দিব্যি সদা-হাস্যময়। হাসি-খুশি।

Powered by Froala Editor