সাইকেল, চুলের কলপ— জীবন কল্প

উত্তর-পূর্ব কলকাতার শেয়ালদা-বৌবাজারের মাঝামাঝি ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট। এই ঠিকানাতেই বসুমতী সাহিত্য মন্দির। লাল রঙের বাড়ি। পাশেই বি সরকার-এর অতিবিখ্যাত স্বর্ণ বিপণি, একদম গা-লাগোয়া যাকে বলে। বসুমতী সাহিত্য মন্দির-এর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডান হাতে বি সরকার। বাঁদিকে লেপ-তোশক সেলাইয়ের দোকান। রেডিমেড রুটিভাজার দোকান। একটা প্রাচীন গাছ, যার গায়ে লাল পাড় কোরা শাড়ি জড়ানো। সেখানে প্রতি শনি-মঙ্গলবার ‘ভর’ হয়। কাছেই লাট্টু পাড়া। সেইখানে বসবাস করা এক নারীর নিয়মিত ভর হয়। জোরে জোরে ঢাক বাজে, কাঁসি, ধূপ-ধুনো পোড়ে। আর একটু— বাঁ হাতে আর একটু আগোলেই ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার খুব বড়ো বাড়ি। বাসস্টপ। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেলে গয়নার ছোটো-বড়ো দোকান। নামী, অনামী, রাস্তার উলটো ফুটেও, সার দেওয়া অলঙ্কারের দোকান। এইসব দোকানের সামনের নর্দমায় পাঁক ঘেঁটে ঘেঁটে, কাদা, নোংরা হাতড়ে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণকুচি বার করেন একদল মানুষ-মানুষী। হাতে তাঁদের লোহার তৈরি সরু মাথা বাঁকা পিন, তা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করতেন সোনার ধুলো। সুবর্ণরেখা নামের নদিকে এইভাবেই প্রায় ‘সোনা খোঁচারা’ কনক-আশায় নদীর বালি খোঁচাতে থাকেন। বলতে গেলে সারা দিনমান চলে এই কাজ। স্যাকরার ঘরের কোণে জমে থাকা— আরও নির্দিষ্ট করে বললে সযতনে জমিয়ে রাখা ঝাঁট দিয়ে দিয়ে, সেই জমা ধুলো বিক্রি হয় বৎসরান্তে। সেই স্বর্ণকণিকা সমৃদ্ধ ধূলি কেনা হয় বছর শেষে। তার জন্য লোকজন আছে আলাদা। ‘দৈনিক বসুমতী’-র দরজার দিকে মুখ করে তাকালে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ওপর ফুটপাতে সাত সতেরো। যৌনক্ষমতা বর্ধক হেকিমি গুলি, সেটা অবশ্য সাধারণভাবে সন্ধের পর, সামনে কার্বাইডে জ্বলা আলো রেখে। আবার বাঁদিকে দিনের বেলা ফুটপাতের ওপর মেদিনীপুরে তৈরি মোষের শিঙের থেকে বানানো মাথা আঁচড়ানোর চিরুনি, মাথার চুল থেকে উকুন বেছে বার করার চওড়া, লম্বায় ছোটো, অতি সরু দাঁড়ার চিরুনি। মোষের শিঙের তৈরি কালো বক, মাছ। এই কাজ পুরীতে দেখেছি। অনবদ্য। পুরীর কটকে তৈরি হত মহিষ শৃঙ্গের গলদা চিংড়ি, জোড়া বক, মাছ। অসাধারণ। কটকে রুপোর ফিলিগ্রি, দেখার, চোখে মেলে দেখার। রুপোর তৈরি ছোটো, বড়ো গহনা, সিঁদুরদানি, কী সব সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম। কাঠের ও মোষের শিঙে তৈরি সিঁদুরদান বা সিঁদুরদানি— সিন্দুর কৌটো তৈরি হয় কটকে, মানে ষাট-সত্তর, আশির দশকেও হত। অসাধারণ, অসাধারণ। ইদানিং এই মহিষশৃঙ্গ শিল্প লুপ্তপ্রায়, মেদিনীপুরে তো বটেই, কটকেও। ষাট, সত্তর, আশির দশকেও যশোরের চিরুনির খুব নাম। কোনো অতি বিখ্যাত চিরুনি কোম্পানি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নিজেদের তৈরি কংঘি বা কাঙ্ঘির বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় ‘যশোরের চিরুনি’— এই বিষয়টি যোগ করে দিত সত্তর-আশির দশকেও। বহু বছরই সেই চিরুনি-বিজ্ঞাপন দেখি না বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায়। যেমন একেবারেই চোখে পড়ে না রেডিও, ট্রানজিস্টার অথবা টিভি-সেটের বিজ্ঞাপনও। বাইসাইকেল— দূষণ না ছড়ানো দ্বিচক্রযান— সাইকেলের বিজ্ঞাপন ক্বচিৎ কদাচিৎ, সেও ‘লেডি বার্ড’ সাইকেল বা অন্য কিছু। ‘ফিলিপস’, ‘হারকিউলিস’, ‘অ্যাটলাস’, ‘সেন হ্যালে’ কোম্পানির তৈরি সাইকেলের বিজ্ঞাপন তো কবেই বন্ধ। আর মান্ধাতার বাপের আমলের ‘হাম্বার’ বা ‘হাম্বর’-কে কে-ই বা মনে রেখেছে? তার বিজ্ঞাপন আমার চোখে অন্তত পড়েনি। ‘অ্যাটলাস’-এর— অ্যাটলাস সাইকেলের লোগোতে ঘাড়ে পাহাড় নেওয়া সেই অতি বীর মানুষটি হাসকিউলিস। জোড়া বন্দুক থাকে তখন অ্যাটলাস সাইকেলের সামনে। ‘ফিলিপ’ সাইকেলের সামনে সিংহের মুখ। কেশর ঝোলানো সগর্জন সিংহ। সেন র‍্য্যালে তৈরি করে ‘অ্যাটলাস’ সাইকেল। রেসিং সাইকেলও তাদের তৈরি। আসানসোলে সেন র‍্যালের খুব বড়ো কারখানা। সম্ভবত সত্তর দশকের গোড়ায় অথবা ষাটের শেষে— ষাট দশকের অন্তিম লগ্নে তাদের সাইকেল ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আর খোলেনি। কথা হচ্ছিল ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিস বসুমতী সাহিত্য মন্দির নিয়ে। দোতলায় উঠতে হয় কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। ভেতরে— ডান দিকে বড়োসড়ো পেচ্ছাপ-পায়খানার জন্য ঘেরা স্পেস রেখে ভেতরে চলে এলেই রিপোর্টার, সাব-এডিটর, চিফ রিপোর্টার-এর বড়োসড়ো টেবিল। সাব এডিটরদের সঙ্গে চিফ-সাব— চিফ-সাব এডিটররাও আছেন। চিফ সাব বলতে জগদীশ সরকার, নির্মল গাঙ্গুলি— নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়, শশাঙ্ক সরকার, সির্মল সেন। নির্মল গাঙ্গুলি ফরওয়ার্ড ব্লকের মানুষ। রঞ্জিত ঘোষ বা রঞ্জিত বসুও ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক। জগদীশ সরকার ইভনিং বা রাতের ডিউটি থাকলে অফিসের ফোন থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতেন, কী নেবেন রাতের আহারে, পরোটা না লুচি? তাঁর সহজীবনের মানুষ— স্ত্রীর প্রতি তাঁর এই কথাবার্তা আশেপাশের সবাই শুনতে পেতাম। তাপস দাস, ত্রিদিব ভট্টাচার্য ছিলেন চিফ-সাব এডিটর। তাপস দাসের দাদা কল্যাণ দাস ছিলেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র রিপোর্টার বা কোর্ট রিপোর্টার— আদালত সংবাদদাতা। আগেও লিখেছি, কল্যাণ দাস সুরূপা হত্যা মামলার রিপোর্ট করতে, আলিপুর জাজেস কোর্টে সুরূপা হত্যা মামলার রিপোর্ট করতে বিচারপতি রণবীর মহাপাড়ের এজলাসে আসতেন নিয়মিত। বড়ো রিপোর্ট, রায় ইত্যাদি হওয়ার থাকলে আনন্দবাজার পত্রিকা ও টেলিগ্রাফের রেগুলার রিপোর্টাররা আসতেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র আদালত সংবাদদাতা কল্যাণ দাস ছিলেন স্ট্রিঙ্গার, রেগুলার রিপোর্টার নয়। মাস গেলে থোক টাকা পেতেন, সেইসঙ্গে এ রিপোর্টের ওপর টাকা। বসুমতী— ‘দৈনিক বসুমতী’-র অন্যতম চিফ সাব এডিটর নির্মল গাঙ্গুলি ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক— আগেই লিখেছি। আর শশাঙ্ক সরকার, যিনি তাঁর নাম চচাঙ্ক সরকার ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে চুবাছ বোস বলতেন, তিনি আগের সুভাষবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক। সুভাষবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক ছিল শীলভদ্র যাজী, ধীরেন ভৌমিকদের। শশাঙ্ক সরকার ব্যাচেলার। তাঁর পোষ্য বহু বেড়াল, তাঁর আস্তানায় এবং দৈনিক বসুমতী দপ্তরে। শশাঙ্ক সরকার তাঁদের জন্য দুধ বরাদ্দ করেছিলেন, কাপে করে মাটিতে ঢেলে দিতেন। সেইসঙ্গে ডিমের ওমলেটের টুকরো। তাঁর এই মার্জার প্রীতি নিয়ে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র ‘কলকাতার কড়চায়’ লেখা হয়েছিল। সে হবে আশির দশকে। শশাঙ্ক সরকারের কাছে দৈনিক বসুমতীর কোনো কর্মচারী বা অন্য কেউ দুর্গা পুজোর ‘পাব্বনী’ বা ‘পার্বণী’ অথবা বকশিস চাইতেন, তিনি সটান জবাব দিতেন সবসময়— ‘আমি বিপ্‌লবী। আমি কাউকে বকচিচ দিই না’। ভীম নামে ‘দৈনিক বসুমতী’-র একজন ক্লাস ফোর বা বেয়ারা ছিলেন, তাঁকে এই কথা বললেই ভীম প্রায় মনে মনে গরগর গরগর করে বলতেন, ‘আপনি বালের বিপ্লবী’। ভীম— যাকে আদর করে কল্যাণাক্ষ বন্দোপাধ্যায় ভীমা— ভী-মা বলতেন, তিনি ছিলেন অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার মানুষ। মাথা জোড়া টাক। ধূধূ যাকে বলে, একদমই তাই। শশাঙ্ক সরকার তাল ঢ্যাঙা। একমাথা চুল-তেল-চিরুনি না দেওয়া, ঝাঁকড়া। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন সম্ভবত দাড়ি কামাতেন, ফলে গাল জোড়া কাঁচা-পাকা দাড়ি। সামান্য বেঁকে গেছেন সামনে। রোগা। চিমসে যাওয়া ঢোকা গাল। কালো ফ্রেমের চশমা। পায়ে স্যান্ডেল— ধূলি ধূসরিত। ধুতির কোঁচা পাঞ্জাবির বাঁ পকেটে গোঁজা। ফলে বক হেন, সরু সরু পায়ের যেটুকু দেখা যায়, তা খরখরে— খড়ি ওঠা— তৈল হীন। হাতে ঘড়ি নেই। খাদির পাঞ্জাবি হাতা গুটিয়ে পরতেন। হাতের নখ— দুহাতের দশ আঙুলের নখই বহুদিন কাটা হয়নি, অপরিচ্ছন্ন। শশাঙ্কদা বলতেন, তাঁকে আনন্দবাজার পত্রিকা ও ‘যুগান্তর’-এ চাকরি দেওয়ার জন্য অশোককুমার সরকার আর তুষারকান্তি ঘোষ— দুজনেই যাকে বইলে ঝুনোঝুনি করছেন, তিনি যাচ্ছেন না। কারণ এই দুটি বাংলা খবরের কাগজ— দৈনিক পত্রিকা এখন আর জাতীয়তাবাদী নেই— সেটা আশির দশকের প্রথম দিক। মনে আছে একবার ঘোর বর্ষার দিনে সুরূপা গুহ হত্যা মামলার রিপোর্ট আলিপুর জাজেস কোর্ট থেকে করে ফিরছি চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম— জাতীয় জাদুঘর হয়ে। সে বড়ই মেঘাক্রান্ত বরিষণ দিবস। বাংলা তারিখের হিসাবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হবে। বড়ো ছাতা থাকে সঙ্গে, যার গোলালো ছায়া আড়াল করে মাথাটুকু। কিন্তু বাকি সব খোলা জায়গা— গা-হাত-পা— সব ভিজে একদম। প্যান্টও। মনে হচ্ছে যেন মরা কুকুরের চামড়া। জড়িয়ে রেখেছি সারা গায়ে। এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আলিপুর জাজেস কোর্ট থেকে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্স, ভারতীয় জাদুঘর, ধর্মতলা হয়ে দৈনিক বসুমতী অফিস, বাসভাড়া— তিরিশ বা চল্লিশ নয়া পয়সার বাস ভাড়া বাঁচাতে। সেটা আশির দশকের গোড়ার কথা। ফুলপ্যান্টের পকেটে একটা বা দুটি সিকি— চৌআন্নি বড়ো জোর, মানে চার আনা, খুব বেশি হলে আট আনা। ব্যাস। তখন এক কলাম— আস্ত এক কলাম খবর ‘দৈনিক বসুমতী’-তে দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে ছাপা হলে পাঁচ টাকা পাই। সুরূপা গুহ হত্যামামলা যতটুকুই ছাপা হোক না কেন, তার জন্য প্রাপ্য দশ টাকা। সেই টাকার বিল দৈনিক বসুমতী অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্যাপে নামাতে ‘দশ হাত জিভ’ অথবা ‘আমরক্ত’ কিংবা দুটোই একসঙ্গে বেরিয়ে যায়। খুব খারাপ দশা। তো সেই হন্টন পথে দৈনিক বসুমতী এসে পৌঁছালাম ভিজে ছাতা, ভিজে চটি আর অতি ভিজে জামা-প্যান্ট সহ। মাথার ওপর বড়ো ছাতার ছাউনিতে কোনো বৃষ্টিই আটকানো যায়নি, সেভাবে। তখন মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। সেই কোঁকড়া চুলের প্রায় ঘাড় পর্যন্ত বাবরি। চুল থেকে জল গড়াচ্ছে— টপ-টপ-টপ। দৈনিক বসুমতীর সাব এডিটরদের ঘরে ষাট পাওয়ারের ডুমের ম্লান আলো। কোনো কারণে টিউব ল্যাম্প জ্বলছে না। দুপুরের কোনো সূর্যালোক ভেতরে, বাইরে কোথাও নেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আশির দশকে পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণে কলকাতার দূরদর্শন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখিয়েছিল। তখন ন্যাশনাল চ্যানেল ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল আর কই? কোথাও নেই। কলকাতায় আছে কলকাতা দূরদর্শন। তো সে যাই হোক, ‘দৈনিক বসুমতী’-র সাব এডিটর রুম থেকে ডান দিকে দরজা দিয়ে বেরলেই দু-দুটো সিঁড়ি। সবই সিমেন্ট বাঁধানো। সাবেকি। ডানদিকের সিঁড়িটি উঠে গেছে তিন তলায়। আর বাঁদিকের সিঁড়িটি নেমে গেছে একতলায়, ক্যানটিনের সামনে। যাকে ‘যুগান্তর’-এর বিষ্ণুদা— বিষ্টুদা বলতেন ‘কেলটিন’। সে অবশ্য ‘যুগান্তর’— বাগবাজার আর পার্ক সার্কাস নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকের তিন তলার গপপো। ঠিক করে বললে গপপো নয়, সত্য, সত্যকাহিনি। শ্যাম মল্লিক বলে একজন সাংবাদিক ছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। তিনি পরে যুগান্তর-এ চলে যান। শ্যামদা রিপোর্টার, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। মাথার চুল সাদা, গোটা মাথা ভর্তি সেই চুল লাল করতেন শ্যামদা। তখন তো এত এত উন্নত, ভ্যারাইটি, বিজ্ঞাপনে অ্যামোনিয়া-শূন্য— অ্যামোনিয়া-ফ্রি কলপ বা চুল রঙ করার বস্তু আসেনি। তখন ‘বাসমল’ পাওয়া যায়, একটু দামি। আরও কিছু অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝময় কলপ। তার মধ্যে ‘ট্রু টোন’ আছে। রয়েছে ‘গোদরেজ’ কোম্পানির দশটাকা দামের কলপ। চৌকো, ছোটো মোটা কাগজ— পিসবোর্ডের প্যাকেট। ভেতরে কলপগুঁড়ো। ষাট, সত্তর দশকে এত এত কপচর্চা ছিল না। বহু মানুষই— পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে কলপ ব্যবহার আশির দশকের শেষ থেকে শুরু, অন্তত এই বঙ্গে। এখন তো বহু দামের ‘লোরিয়েল’ কলপ। সেই কলপ-বাক্সে ঐশ্বর্য রাই কখনও, কখনও ক্যাটরিনা কাইফ। কখনও বা বিদেশি সুন্দরী। আমার জানা অনুযায়ী, ‘লোরিয়েল’ সবচেয়ে দামি কলপ, অন্তত এই বঙ্গে ছশো— হ্যাঁ, ছশো টাকার ওপরে তার দাম। ‘লোরিয়েল’-এর দাম অতি দ্রুত চড়তে থাকে। চড়ে। থাক সেসব কথা। আগে আগে— ষাট-সত্তরে বাঙালি মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তদের মধ্যে খুব বেশি কলপচর্চা ছিল না। বিদেশে, মানে ইউরোপে তো নয়ই। ইউরোপিয়রা ও তাঁদের অনুসারীরা মাথায় উইগ দিতেন, সাদা উইগ— পরচুলা, বিশেষ করে বিচারপতি ও জুরিরা। অন্য অন্য নামিরাও। উইফ বা প্রচুলা একটা স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে। সেই ছবি পুরনো দিনের ফটোগ্রাফ, পেইন্টিং-এ বার বার দেখা গেছে। আমি নয়, আমরা বরং আবার ‘দৈনিক বসুমতী’ ফেরত ‘যুগান্তর’-এ জয়েন করা শ্যাম মল্লিক প্রসঙ্গে ফিরি। রিপোর্টার শ্যাম মল্লিক। ‘দৈনিক বসুমতী’-তে শ্যামদা— শ্যাম মল্লিক কিছুকাল খেলাধুলোর সাংবাদিকতা— স্পোর্টস জার্নালিজম করেন। তারপর রেগুলার সাংবাদিকতাও, জেনারেল রিপোর্টারি। শ্যামদা— শ্যাম মল্লিক তেমন লম্বা নন, পেটানো স্বাস্থ্যের সঙ্গে অ্যাালকোহলিক ভুঁড়ি। প্রচুর মদ্য পান করতেন। নিয়মিত ক্যালকাটা প্রেস ক্লাব। এইআই ক্লাব কখনও। শ্যামদা ক্লিন শেভেন। তবু ঘন কৃষ্ণ গালে কোনো কোনোদিন সাদা দাড়ির গুঁড়ো। টেরিকটের রঙিন ফুল প্যান্ট আর হাফশার্ট। বুক কাটা— বুশ শার্ট। রিঙিন। হাতে চামড়ার সরু ফোলিও ব্যাগ। পায়ে স্যান্ডেল। হাতে রিস্ট ওয়াচ। তো সেই শ্যাম মল্লিকের মাথার ঘন চুল কখনও কাশফুল রঙের ফকফকে সাদা। কখনও তার ওপর লালচে রংদারি। মেহেন্দি অথবা লাল কলপ। শ্যামদা একটু চিতব্যাক দিয়ে পেছনের দিকে সামান্য কাত হয়ে হাঁটতেন। ঘন ঘন সিগারেট। শ্যাম মল্লিক প্রসঙ্গে মনে পড়ল অভিনেতা শ্যাম লাহার কথা। কমিক্যাল চরিত্রে অনবদ্য। জিতেন বসু, শ্যাম লাহা— দুজনকেই আর কারা মনে রেখেছেন? শ্যাম লাহার মাসল, গোঁফ চোখে পড়ার। এছাড়া আর একজন শ্যাম— আমার জানা শোনার মধ্যে বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়-এর শ্যামসুন্দর শী। টাক মাথা, ফুল প্যান্ট, ফুল শার্ট— তিনি ছিলেন বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়-এর ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট। সেই সঙ্গে এই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার— লাইব্রেরিটিও তিনিই দেখাশোনা করতেন, মানে তাঁর দায়িত্বে ছিল। শ্যামসুন্দর মিত্র ছিলেন বাংলা ও পূর্বাঞ্চলের অতি অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। অফিসিয়াল টেস্ট খেলতে পারেননি। কিন্তু দিলীপ ট্রফি ও রঞ্জি ট্রফিতে তাঁর শতরান, দ্বিশতরান অনেক। তিনি ছিলেন খুবই নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান— বাংলা ও পূর্বাঞ্চলের। কিন্তু ফিল্ডিং তেমন ভালো ছিল না। যাই হোক, আবার শ্যাম মল্লিকে ফিরি। শ্যাম মল্লিক ‘যুগান্তর’-এ স্পোর্টসের সঙ্গে সাধারণ রিপোর্টও করতেন। পুলিশ বিট, কর্পোরেশন বিট, এডুকেশন বিট, পলিটিক্যাল বিট। 

Powered by Froala Editor