থর মরুভূমির বুকে স্নো ট্রাউট মাছ, জানাচ্ছে রাজস্থানের প্রাচীন নদীর হদিশ

আজ থেকে ৩৩ বছর আগে থর মরুভূমির বুকে দেখা মিলেছিল বেশ কিছু স্নো ট্রাউট মাছের। সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বেশ আশ্চর্যজনকভাবেই। হিন্দুস্তান জিঙ্ক লিমিটেডের হয়ে আরাবল্লী পর্বতের কাছে কিছু জায়গা জরিপের কাজ করছিলেন রাজা তেহসিন। আর তখনই মাটির নিচে জলের সন্ধান পাওয়া যায়। মরুভূমি অঞ্চলে জলের অভাবে কারখানা দীর্ঘদিন বন্ধই ছিল। আবার কাজ শুরু হল পুরোদমে। তবে কারখানার কর্মচারীদের কাছে তেহসিন অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কোনো মাছের সন্ধান পেলে তাঁকে জানাতে। মাসখানেক পর তেহসিন যখন আবার সেখানে গেলেন, তখন শুনলেন প্রথমদিকে জলের সঙ্গে প্রচুর মাছ উঠেছিল। তবে শ্রমিকরা বেশিরভাগ মাছই খেয়ে ফেলেছেন। শুধু একটি মাছ তেহসিনের জন্য তাঁরা রেখে দিয়েছিলেন। আর সেই নমুনাটি দেখেই চমকে ওঠেন তেহসিন।

এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৮৭ সালে। মাছটির বেশ কিছু ছবি তুলে এবং একমাত্র নমুনাটিকে ফর্ম্যালিনে ডুবিয়ে তেহসিন পাঠিয়েছিলেন মোহনলাল সুখাড়িয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক ভি. এস. দুর্বের কাছে। প্রথমেই তিনি তেহসিনের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। মাছটি স্নো ট্রাউট প্রজাতিরই। তবে আরও কিছুদিন পরীক্ষানিরীক্ষার পর তাঁর মনে হয়, না কিছু পার্থক্য রয়েছে। তবে জিনগত বৈসাদৃশ্যের থেকে সাদৃশ্যই বেশি। আরও বেশি তথ্য জানার আশায় নমুনাটি পাঠানো হয় বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। তবে সেখানেও উপযুক্ত তথ্য না থাকায় সেটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় লন্ডন মিউজিয়ামে। ঘটনাচক্রে লন্ডনেই নমুনাটি হারিয়ে যায়। এখনও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু যেটুকু তথ্য জানা গিয়েছে, তার ভিত্তিতেই গবেষণা করে রাজস্থানের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে অবাক করা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন গবেষকরা।

সম্প্রতি অধ্যাপক দুর্বের এক ছাত্র, এম কূলশ্রেষ্ঠ, তাঁর গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন আজকের শুষ্ক থর মরুভূমিতেই এমন বেশ কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব আছে, যাদের প্রকৃত বাসভূমি হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে। এই স্নো ট্রাউট প্রজাতির মাছও সেখানেই পাওয়া যায়। ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে এবং চিনে পাওয়া স্নো ট্রাউটের সঙ্গে তেহসিনের সন্ধান পাওয়া মাছটির আশ্চর্য মিল সত্যিই অবাক করে। তাঁর গবেষণাপত্রটি পড়ে যোগাযোগ করেন ভূতত্ত্বের অধ্যাপক এস. এস. মেহর। তিনি লুনি এবং ঘগর নদীর গতিপথ নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়েও এক আশ্চর্য সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাঁর মতে আরাবল্লী পার্বত্য অঞ্চলের নদীগুলি আসলে হিমালয় থেকেই জন্ম নিয়েছে। এক সময় হিমালয় থেকে এমন অনেক নদী রাজস্থানের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে গিয়ে পড়ত। পরবর্তীকালে টেকটনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের ফলে সেইসব নদী হারিয়ে গিয়েছে। তবে ঠিক কতদিন আগে রাজস্থানের উপর দিয়ে হিমালয়ের বরফগলা জল প্রবাহিত হত, সেই তথ্য জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।

অধ্যাপক মেহর নিশ্চিতভাবে তাঁর গবেষণার প্রমাণ পান রাজা তেহসিনের অনুসন্ধানে। তাঁর বিশ্বাস, আজও রাজস্থানের মাটির নিচের বাস্তুতন্ত্র পরীক্ষা করলে এমন অনেক আণুবীক্ষণিক জীবের সন্ধান পাওয়া যাবে, যাদের জন্ম হিমালয়ের বুকে। স্নো ট্রাউট তার একটি বড় উদাহরণ মাত্র। তবে এই দীর্ঘ জলবায়ু পরিবর্তনের পথ পেরিয়েও একটি বড়ো মাছ কীভাবে বেঁচে ছিল, সেকথা ভাবতে সত্যিই অবাক হতে হয়। হয়তো আর কোনোদিনই তার প্রকৃত রহস্য জানা যাবে না।

Powered by Froala Editor