অস্কারজয়ী ‘গান্ধী’-র প্রযোজক ছিলেন তিনি; প্রয়াত সাহিত্যিক-সাংবাদিক অনিল ধারকার

প্রতি বছর নভেম্বর মাস পড়লেই চেহারা বদলে যায় বাণিজ্য নগরীর। তারকার আলোয় আলোকিত হয়ে হঠে শহর। আলোকিত হয়ে ওঠে সাহিত্যচর্চা এবং সমসাময়িক সাহিত্যের বিশ্লেষণাত্মক আলোচনায়। হ্যাঁ, মুম্বাই আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠানের কথাই হচ্ছে। চলে গেলেন এই সাহিত্য উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান পরিচালক অনিল ধারকার। ব্যক্তিগত সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতার পাশাপাশি সমানভাবে তিনি গবেষণা করেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়েও।

শুক্রবার মুম্বাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অনিল ধারকার। বৃহস্পতিবারই তাঁর হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তবে বাইপাস সার্জারির ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারলেন না তিনি। শুক্রবার সকালেই থেমে গেল লড়াই। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

দক্ষিণ ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত ধারকারের শুরুর জীবন ছিল একেবারেই অন্যরকম। নিজের ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। গণিতে স্নাতক অর্জনের পর ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন। তারপর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো। মূলত বিল্ডিং সার্ভিসের ওপরেই সেখানে বিস্তারিত পঠনপাঠন করেন তিনি। 

দেশে ফিরে প্রথম সারির স্থাপত্য সংস্থা ফোরজ কুডিয়ানাভালা-তে উপদেষ্টা হিসাবে শুরু করেন কেরিয়ার। সেখানেই কোনো নির্মাণে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এবং প্রতিরোধকের ওপর বিস্তারিত গবেষণা করেন তিনি। স্মোক ডিটেক্টর, স্প্রিংক্লার, পজিটিভ এয়ার প্রেসার ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ যন্ত্রাংশের ব্যবহার তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় ভারতে। সেটা সত্তরের দশক। ভারত বহু অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলেও তখনও পর্যন্ত তেমনভাবে গুরুত্বই দেয়নি এমন একটি বিষয়কে। সাহিত্যিক বা সাংবাদিক অনিল ধানকারের জনপ্রিয়তা কোথাও হয়তো ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে সেই ইতিহাসটাকেই।

আরও পড়ুন
সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করেই আদিবাসী মহিলাদের জন্যে লড়াই ওড়িশার জয়ন্তীর

তবে পড়াশোনা কিংবা কাজের বাইরেও তাঁর অন্যতম নেশা ছিল সিনেমা। শুধু সিনেমা দেখাই নয়, তার বিশ্লেষণ, সমালোচনা করেও বহু প্রবন্ধ লিখতেন তিনি সেই সময় থেকেই। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতও হত সেসব। সেসব লেখায় মুগ্ধ হয়েই ফিল্ম সেন্সরবোর্ডে তাঁকে নিযুক্ত করেন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী। সরলীকৃত সেনসরশিপ কোডের খসড়া তৈরি করেছিলেন ধারকারই। 

পরবর্তীতে ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনে প্রধানের দায়িত্বও সামলেছেন ধারকার। কাজ করেছেন অপর্ণা সেন, কেতন মেহতা, গোবিন্দ নিহালনি, বিধু বিনোদ চোপড়া, গৌতম ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। দক্ষিণ বম্বের আর্ট-মুভি থিয়েটার আকাশবাণী অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠার পিছনেও ছিলেন তিনি। তবে সিনেমাজগতে তাঁর সবথেকে বড়ো অবদান রয়েছে রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ সিনেমাটির পিছনে। সহ-প্রযোজকের ভূমিকা ছাড়াও বিভিন্নভাবে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন পরিচালককে। যা পরবর্তীতে এনে দিয়েছিল অস্কার। ভারতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব তো বটেই কান, বার্লিন, শিকাগো, লন্ডনের মতো চলচ্চিত্র উৎসবেও বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্যের ভূমিকা পালন করেছেন অনিল ধারকার।

আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার উত্তরপ্রদেশে, ‘রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আড়ালে কি কণ্ঠরোধের চেষ্টা?

পাশাপাশি প্রকাশনা করতেন ‘ডেবোনের’, ‘মিড-ডে’, ‘সানডে মিড-ডে’-র মতো জনপ্রিয় পত্রিকা। টাইম অফ ইন্ডিয়া, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’তে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। তবে পরে টাইমস গ্রুপকে বিদায় জানিয়ে যোগ দেন ইন্ডিয়া টিভি চ্যানেলে। সামলেছেন জি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের পদ। দূরদর্শনে তাঁর নেওয়া একাধিক প্রধানমন্ত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, লেখক, অভিনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নেওয়া শতাধিক সাক্ষাৎকার— আজও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ জাতীয় আর্কাইভের। বার বার তাঁর সেসব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সমসাময়িক সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। যা ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। সাম্প্রতিক সময়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, ইকোনমিক টাইমস, ফাইনানসিয়াল ক্রোনিকল, ডেকান ক্রোনিকল, হাফিংস্টোন পোস্ট-সহ একাধিক পত্রিকাতেই স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করতেন অনিল ধারকার। সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছেন বহু পুরস্কারও।

মুম্বাই আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব তো বটেই, মহারাষ্ট্রের ছোট-বড়ো সমস্ত সাহিত্য সভাতেও হাজির হতেন তিনি। লক্ষ্য ছিল তরুণ প্রজন্মের লেখকদের উদ্দীপনা জোগানো। লিখেছেন বেশ কয়েকটি বই। যার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর ডাণ্ডি অভিযানের ওপর নির্মিত ‘দ্য রোমান্স অফ সল্ট’ অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ।

আরও পড়ুন
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় : বাংলার প্রথম ‘ব্র্যান্ডেড’ সাংবাদিক-সম্পাদক?

তবে চেনা অনিল ধারকারের থেকে অচেনা ধারকারের পরিধি যেন অনেক অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক খেলার মাঠেও ফুল ফুটিয়েছেন এক সময়। ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, স্কোয়াস প্রভৃতি খেলায় ধারাবাহিকভাবেই অংশ নিতেন তিনি। কলেজ তো বটেই, বরং কর্মজীবনেও। এমনকি লন্ডন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে টেবিল টেনিসের অধিনায়কত্বও করেছেন ধারকার। 

প্রখ্যাত এই ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে সাহিত্যমহলে। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজদীপ সারদেশাই, উইলিয়াম ডালারিম্পল, শশী থারুর প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা। বিগত পাঁচ দশক ধরে চলতে থাকা এক রাজত্বেরই যেন শেষ হল। ভারত হারাল তাঁর সর্বগুণসম্পন্ন এক নক্ষত্রকে…

Powered by Froala Editor