শুধু সাংবাদিক বা নাট্যব্যক্তিত্বই নন, মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম মুখ ছিলেন কামাল লোহানী

সাল ১৯৬১। রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত তো বটেই; এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় ছিল ওপার বাংলাও। তখন অবশ্য যার নাম পূর্ব পাকিস্তান। মাত্র নয় বছর আগেই চলে গেছে রক্তমাখা এক ২১শে ফেব্রুয়ারি। সেই জ্বলন্ত মুহূর্তের মধ্যেই রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল পাকিস্তান সরকার। প্রতিবাদে গর্জে উঠল গোটা পূর্ব পাকিস্তান। সেই প্রতিবাদেরই পুরোভাগে ছিলেন একজন। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, ঝকঝকে দৃপ্ত একটি মুখ। এর আগেও এই সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। আয়োজন করছেন ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের। সেদিনের ‘বজ্রসেন’ আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। এতদিনের লড়াইয়ের ময়দান থেকে অবসর নিলেন কামাল লোহানী।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের নানা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন কামাল লোহানী। পেশাগত দিক থেকে ছিলেন সাংবাদিক। বহু পত্রিকার সঙ্গে কাজ করেছেন, মুখ্য দায়িত্বও নিয়েছিলেন। তাই সত্যের খোঁজ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা ও সাহস তিনি দেখিয়ে গেছেন অবিরাম। কোনো কিছুর পরোয়া না করে শুধু সমাজের জন্য, মানুষের জন্য রাস্তায় নামা— এমন ধারাতেই বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।

দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা থেকে শুরু হয় কর্মজীবন। পরবর্তীতে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, বঙ্গবার্তা, দৈনিক বার্তা ইত্যাদি বহু সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর উদ্যোগ ও কাজ আজও মনে করে বাংলাদেশ। ১৯৬২-এর রবীন্দ্র শতবর্ষের উদযাপন বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদের জন্য গ্রেফতার হন। পরে বাইরে এসে আবারও জোর কদমে শুরু করেন আন্দোলন। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নেন। সেই সময় ঢাকার বেতার কেন্দ্র প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। কামাল লোহানী সেখানে এসে নতুন করে সব তৈরি করার দায়িত্ব নেন।

আন্দোলন, প্রতিবাদ, নির্ভীক সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের অন্যতম মুখও। নৃত্যনাট্য, নাটক, নাচেও অংশ নিয়েছেন বারবার। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ থেকে শ্যামা— দর্শকরা নানা সময় তাঁকে মঞ্চে দেখেছেন। তবে শুধু শিল্পী হিসেবেই নয়, সাংগঠনিক প্রধান হিসেবেও তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে ‘ছায়ানট’-এর সম্পাদক হন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় সেখান থেকে অব্যহতি নেন। পরে ২০০৮ সালে আবার সেই চেয়ারে ফিরে আসেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। একুশে পদক, কলকাতা কর্পোরেশনের দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা-সহ বহু সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু জীবনের মাঠ থেকে একদিন না একদিন তো চলে যেতেই হয়। হার নয়, বীরের মতোই বিদায় নিতে চেয়েছিলেন তিনি।

৮৭ বছর বয়সে বার্ধক্য আর করোনা ভাইরাস কামাল লোহানীকে সেই দরজায় এনে দাঁড় করাল। ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন তিনি। শেষ হল বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক দৃপ্ত, সাহসী ইতিহাসের… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More