সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করেই আদিবাসী মহিলাদের জন্যে লড়াই ওড়িশার জয়ন্তীর

“আমাদের গ্রামে, এবং আদিবাসী সমাজে এখনও মেয়েরা পিছিয়ে আছে। তারা পড়াশোনার সুযোগ পায় না। এমনকি, কাজ করার জন্য ন্যূনতম যে শিক্ষা দরকার, সেটুকু অর্জন করতেই অনেকের কষ্ট হয়। আমি চাই, আমার কাজ যেন আরও মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলে। তারা যেন সঠিক শিক্ষা, পরিকাঠামোর সুযোগ পায়। আমিও এজন্যই সাংবাদিকতায় এসেছি; যাতে এই সমস্ত সমস্যাগুলো আরও বড়ো জায়গায় তুলে ধরতে পারি।”

বলছিলেন জয়ন্তী বুরুদা। পেশায় ওড়িশার একজন সাংবাদিক। কিন্তু এটুকু বললেই কি আর সবটা বলা হল? জয়ন্তী একজন যোদ্ধা। মালকানগিরির মেয়েদের কাছে তিনি এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। যত এগোচ্ছেন, দেশের আর সমাজের রূপগুলো চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে। অবশ্য এটাই তো চান জয়ন্তী। একজন সাংবাদিকের কাজই তো সেটা। সেখানে জুড়ে আছে সমাজ, জুড়ে আছে দেশ; জুড়ে আছে তাঁর গ্রাম সরপালি।

“প্রথমত আমি মেয়ে। দ্বিতীয়ত আমি কোয়া আদিবাসী গোষ্ঠীর একজন। সমাজের মধ্যে এমনিই পিছনের সারিতে আমরা। যেন বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখাটাই অপরাধ আমাদের জন্য। কিন্তু আমি, আমার পরিবারের বাকিরা থেমে থাকেনি। কারণ এখানে থেমে গেলে, আমার লক্ষ্যগুলো যে পুরো হবে না। এই গ্রামের কথা, এখানকার অবস্থার কথা জানাতে পারব না”, বলছিলেন জয়ন্তী। ওড়িশায় দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করছে এই কোয়া আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষরা। ভারতের বৃহত্তর সামাজিক ছবির সঙ্গে কোথাও হয়তো আলাদা করা যাবে না এঁদের। এখানে মেয়েরা বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও করতে দেওয়া হয় না। মেয়েরা আবার এসব করবে নাকি? বরং তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেলেই ভালো। ছোটো বয়সেই একেকজনের ঘরসংসার তৈরি হয়ে যায়। যদিও বা স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল, সেসব একেবারে মাটিতে মিশে যায়… 

আরও পড়ুন
ঋতুস্রাবের ট্যাবু ভাঙতে মেনস্ট্রুয়াল কাপকে অস্ত্র করে লড়াই কলকাতা-তনয়ার

আরও পড়ুন
পরিবারের সামনেই ধর্ষিত হন দলিত মেয়েরা; দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে বিহারে লড়াই স্মিতার

জয়ন্তীরা এমন জীবন চায়নি। চায়নি তাঁর পরিবারও। বাবা নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে গেছেন পড়াশোনার জন্য। একা জয়ন্তী নয়, সেইসঙ্গে তাঁর চার দিদিই পড়াশোনা করেছেন। নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়েছেন একটু একটু করে। “শুধুমাত্র কোয়া আদিবাসী গোষ্ঠীর মধ্যেই নয়, আমার দিদি মালকানগিরির প্রথম গ্র্যাজুয়েট। আমাদের পরিবারও মালকানগিরির প্রথম শিক্ষিত পরিবার, যেখান থেকে মেয়েরা কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গেছে। নিজেদের মতো কাজ করছে।” শিক্ষার ভিতটা নিজের পরিবারের মধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তীর। স্কুল পেরোনোর পর কী করবেন তিনি? জয়ন্তী বুরুদা বেছে নিলেন সাংবাদিকতাকে। ছোটো থেকেই দেখে এসেছেন নিজের গ্রামকে। দেখেছেন মালকানগিরি জেলাকেও। একটু একটু করে সমাজসেবার কাজও শুরু করেছিলেন। “আমি ভাবলাম, সংবাদমাধ্যমে কাজ করলে আমার সমাজসেবার কাজটাও ভালোভাবে হবে। আরও অনেক কিছু জানতে পারব, আরও অনেক জায়গায় পৌঁছতে পারব। প্রধানত এমন ইচ্ছে থেকেই জড়িয়ে পড়া”, বলছিলেন জয়ন্তী। 

আরও পড়ুন
থানা অব্দি পৌঁছয় না অনেক ধর্ষণের ঘটনাই, ক্ষোভে ফুঁসছেন উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী রূপরেখা ভার্মা

আরও পড়ুন
বাঙালিদের মধ্যে প্রথম মহিলা মার্শাল আর্ট ট্রেনার, মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সুতপা পাত্র

এবার বাড়ি থেকে একটু বাধা এল। কারণ এর আগে কোয়া গোষ্ঠীর কেউই এই পেশায় আসেননি। অনেক ঝুঁকির কাজ এটা। একটা মেয়ে হয়ে পারবে জয়ন্তী? বাড়ির বাকিদের মনে সংশয় থাকলেও জয়ন্তীর মধ্যে ছিল না। তাঁর লক্ষ্য স্থির। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। বাড়ির অবস্থা সেরকম নয়। কলেজ হোস্টেলে গিয়ে থাকার, খাওয়ার মতো পয়সাটুকুও নেই। “এমনও হয়েছে, ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, তবুও টানা ১৫ দিন ক্লাস করিনি আমি। আমার কাছে তখনও থাকার জায়গা ছিল না। কোথায় একটু সাধ্যের মধ্যে জায়গা পাব, এটাই তখন চিন্তা।” কথাগুলো বলার সময় বেশ কয়েকবার থামলেন জয়ন্তী। মনে পড়ছিল সেইসব দিনগুলোর কথা। এমন সময়ই সহায় হন তাঁরই এক বন্ধুর মামা। কলেজের কাছেই তাঁর বাড়িতে থাকতে শুরু করেন জয়ন্তী। আর ফিরে তাকাননি। যাত্রা এগিয়েছে তরতরিয়ে… 

আরও পড়ুন
কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি

এখন ওড়িশাতেই একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করছেন জয়ন্তী বুরুদা। তাঁর কাছে সুযোগ ছিল বাইরে চলে যাওয়ার। নিদেনপক্ষে ওড়িশাতেই কোনো বড়ো জায়গায় থেকে কাজ করার। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন নিজের জায়গা, মালকানগিরিকে। “প্রথম থেকেই ইচ্ছা ছিল, যদি সংবাদমাধ্যমে আসি, তাহলে নিজের জেলাতেই কাজ করব। এখানকার সমস্যাগুলো তুলে আনব। বিশেষ করে মেয়েদের কথা। পড়াশোনার সুযোগ কম তাঁদের। স্কুলছুটের সংখ্যাও বেশি। আমি যদি তাঁদের খবর তুলে আনি, তাঁদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলি, সেটাই তো আসল কাজ হবে। আমাকে দেখে আরও মেয়ে যদি এগিয়ে আসে, সেটা তো আখেরে গোটা জেলা ও গ্রামগুলোরই উন্নতি হবে”, বলছিলেন জয়ন্তী। 

সরপালি ও মালকানগিরির মেয়েদের কাছে এজন্যই তিনি এক উদাহরণস্বরূপ। শুধু তাঁকে দেখেই অনেকে কাজ করতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু সমস্যা কি কেবল এখানেই থেমে আছে? দীর্ঘ অনেক বছর ধরে মালকানগিরি মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা। অনেক সময় পুলিশ-প্রশাসনের পদক্ষেপের শিকার হন নিরীহ গ্রামবাসীরা। সেই সঙ্গে আছে লিঙ্গভেদ। নিজের জীবনে এসব অনুভবও করেছেন জয়ন্তী। “মালকানগিরিতে যখন প্রথম কাজ করতে আসি, আমার সিনিয়ররা মেনে নিতে পারেনি। কারণ, আমি আদিবাসী এবং সবথেকে বড়ো কথা, আমি একজন মেয়ে। ‘মেয়ে হয়ে সাংবাদিকতায় কী করবে তুমি?’ এমন প্রশ্নের সামনেও দাঁড়াতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অথচ আমি নিজের যোগ্যতায় এখানে এসেছি। একবার থানা থেকে হঠাৎই ডেকে পাঠানো হয় আমাকে। তারপর চলে এক ঘণ্টার দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ। আমি কোথায় থাকি, কী করি, পড়াশোনা কোথায় করেছি, কার কার সঙ্গে যুক্ত ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। যতবারই জিজ্ঞেস করেছি কেন আমাকে এসব প্রশ্ন করা হচ্ছে, কোনো উত্তর আসেনি। এমনকি সিবিআই অফিস থেকেও বারবার ফোন করা হয় আমাকে। কেন, তার উত্তর আসেনি। 

এই জিজ্ঞাসাবাদের কয়েকদিন আগেই আমি একটি ভিডিও পোস্ট করি ফেসবুকে। পরে আমারই এক পরিচিতকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ওই ভিডিওর জন্যই তোমাকে ডাকেন ওঁরা। কোনো মাওবাদী ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত আছি কিনা সেসব জানার জন্যই এত কিছু। আমি শুনে তাজ্জব! আমি একজন আদিবাসী মেয়ে, পড়াশোনা করেছি, ইংরেজি-হিন্দিতে কথা বলতে পারি— সেজন্য আমাকে মাওবাদী সন্দেহ করা হবে?”

জয়ন্তীর প্রতিবাদ এর বিরুদ্ধেও। আর সেজন্যই সাংবাদিকতার সঙ্গে নিজের সমাজসেবামূলক কাজকর্মও চালান। ‘ট্রাইবাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস মিশন’ নামে একটি সংগঠনও চালান তিনি। আজ থেকে নয়, সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে। সমস্ত আদিবাসী সমাজ থেকে মহিলারা যাতে উঠে আসেন, সেখানে ঠিকমতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিকাঠামো যাতে গড়ে ওঠে এটাই চেষ্টা করেন তাঁরা। সেইসঙ্গে জয়ন্তীরা নিজে গিয়ে সেখানকার বাচ্চাদের পড়াশোনায় সাহায্য করেন। “এখনও মালকানগিরির অনেক জায়গায় রাস্তার সমস্যা। এছাড়া আরও অনেক কাজ আছে। সবটুকু মিলিয়েই চেষ্টা করছি আমরা।” 

এটুকু বলেই হেসে ওঠেন জয়ন্তী বুরুদা। এখনও অনেকটা রাস্তা তাঁকে পেরোতে হবে। অনেক চড়াই উতরাইয়ের সম্মুখীন হবে জীবন। কিন্তু থামতে জানেন না তিনি। সাংবাদিতকতাকে হাতিয়ার করে নিজের কথাগুলো বলে যাবেন তিনি। আজ কোয়া আদিবাসী গোষ্ঠী এবং আরও সব জায়গায় যাতে হাজার হাজার জয়ন্তী জন্ম নেয়, সেই চেষ্টাই করে যাবেন তিনি। এটাই যে তাঁর কাজ। সেই ছোট্টবেলার লক্ষ্য। চতুর্থ স্তম্ভের মতোই তিনি দৃঢ়, মজবুত; আর আছে একরাশ স্বপ্ন…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More