পায়ের নিচে ‘দুজন’ শিব, শ্বেতবর্ণা কালীও, দেখা মেলে বাংলাতেই

হাওড়া-তারকেশ্বর রেলপথে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাস ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় রাজবলহাটে। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনস্থান তথা বাংলার তাঁত-শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান রাজবলহাট। তবে এই গ্রামেই রয়েছে আরেক বিস্ময়। একটি কালীমন্দির। মাতা রাজবল্লভীর মন্দির (Rajballavi Kali Temple)  নামেই যা পরিচিত। কালীমূর্তি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘোর কৃষ্ণবর্ণা বা গাঢ় নীল বর্ণের মূর্তি। তবে রাজবল্লভী মাতার মূর্তি কিন্তু একেবারেই তেমন নয়। তাঁর গায়ের রং শরতের জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল, অর্থাৎ শ্বেতবর্ণ (White Kali Idol)।

জাঙ্গিপুর পুলিশ ফাঁড়িকে ডাইনে রেখে ঘুরতেই চোখে পড়বে রাজবল্লভী মায়ের মন্দিরের প্রবেশপথ। প্রবেশপথ পেরোলেই এক বিরাট নাটমন্দির। নাটমন্দিরকে ঘিরে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। অতিমারী পরিস্থিতিতেও সেখানে ভক্তদের ভিড় নেহাৎ কম নয়। নাটমন্দির পেরিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতেই শ্বেতকালীর মূর্তিটি চোখে পড়বে। প্রায় ৬ ফুট উচ্চতার মূর্তিটি বিবসনা নয়, নয় চতুর্ভুজাও। দেবীর পরনে স্থানীয় তাঁতিদের বোনা শাড়ি। দুটি হাতের একটিতে ছুরি, অন্যটিতে রুধির পাত্র। পায়ের নিচে একটি নয়, বরং দুটি শিবমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। ডান পা রয়েছে কালভৈরবের বুকের উপরে। আর বাম পা রাখা আছে বিরূপাক্ষ শিবের মাথার উপরে।

শোনা যায়, বহুকাল আগে যখন এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে কংসাবতী নদী বয়ে যেত, তখনই এক সদাগর দেবীর দেখা পান। তিনিই এখানে মন্দির তৈরি করেন। তবে সে নিছক লোককথা। ইতিহাসেও রাজবল্লভী মায়ের মন্দির নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন আনুমানিক ১২৪২ সালে ভূরসুটের রাজা সদানন্দ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। আবার অনেকের মতে, মন্দিরের বয়স ততটা পুরনো নয়। বরং ষোড়শ শতকে রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় নির্মাণ করেন মন্দিরটি।

তবে রাজবল্লভী মায়ের পুজোর ইতিহাস সম্ভবত আরও অনেক প্রাচীন। একসময় এই অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস ছিল। তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের বেশ প্রসারও ঘটেছিল। সম্ভবত তখন থেকেই চলে আসছে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই পূজার্চনা। দেবীর সঙ্গে এখানে পূজা পান নীল সরস্বতী এবং তারা। এঁরা দুজনেও বৌদ্ধ দেবী। আবার দুই পুরুষ অবতারের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ানো শক্তিমূর্তিটিও বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত অনেক পরে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পান বলেই দেবীর নাম রাজবল্লভী।

আরও পড়ুন
পাথুরিয়াঘাটার এই কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে বাঘাযতীন-সুভাষচন্দ্রও!

আজও পূজার্চনার রীতিনীতিতে নানা তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। নিয়মিত ছাগবলির পাশাপাশি শারদ অষ্টমীতে মেষ বলির রীতি বহাল রয়েছে। ছাগ বলি অবশ্য এখানে হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে হয় না। বরং ছাগলটিকে ঝুলিয়ে রেখে প্যাঁচ দিয়ে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। বলির পর গর্ভগৃহের পিছনের খপ্পরে পশুদের দেহাংশ ফেলে রাখা হয়। শোনা যায় এই খপ্পরের জায়গাটিতেই একসময় ছিল রাজা সদানন্দের পঞ্চমুণ্ডের আসন। এখানে বসে তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের সমস্ত প্রাচীন নিদর্শনই হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমান মন্দিরের বয়স একশো বছরের বেশি নয়।

আরও পড়ুন
জার্মানির ডক-লিপজিগ তালিকায় কালীঘাটের যৌনপল্লি নিয়ে তৈরি সিনেমা

রাজবল্লভী দেবীর স্বভাবও রাজকীয়। তিনি প্রতি রাত্রে কাঠের পালঙ্কে নিদ্রা যান। রাতে হঠাৎ তামাক সেবনের ইচ্ছাও হয় মাঝে মাঝে। তাই মন্দিরের এক কোণেই প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া। তবে খাবারের বিষয়ে তাঁর কোনো আড়ম্বর নেই। কোনোরকম সম্বরা না দিয়ে প্রতিদিন সিদ্ধ ভোগ রান্না হয় মন্দিরের লাগোয়া রন্ধনশালায়। রোজ অন্তত হাজারজন ভক্তকে সেই ভোগ পরিবেশন করা হয়।

আরও পড়ুন
‘সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, বলেছিলেন উত্তমকুমার

রাজবলহাট ছাড়াও কিন্তু আরও দুই জায়গায় শ্বেতকালীর সন্ধান পাওয়া যায়। তার একটি আবার খোদ কলকাতার বুকে। শোভাবাজারের এই মন্দিরটি আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে নির্মিত হয়েছিল। শোনা যায় তখন এখানে ডাকাতরা পুজো করতেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তন্ত্রমতে পুজো দিয়ে যেতেন। অপর মন্দিরটি রয়েছে ব্যান্ডেল স্টেশনের নিকটেই। কোনো রাজার সঙ্গে তাঁদের কাহিনির যোগ না থাকলেও তাঁরাও রাজবল্লভী। তাঁদের প্রত্যেকের গায়ের রং শরতের জ্যোৎস্নার মতো সাদা।

তথ্যসূত্রঃ
১. বাংলার প্রাচীন কালীকথা, পরিব্রাযক শিবশঙ্কর ভারতী
২. রাজবলহাট: একটি বিখ্যাত আধা নগর, অরিন্দম গায়েন, International Journal of Humanities & Social Science Studies (IJHSSS)

Powered by Froala Editor

More From Author See More