রোগী সেজে হাসপাতালগুলিকে বোকা বানিয়েছিলেন যে অধ্যাপক

রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময় মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু এমন কখনও ভেবেছেন যে ওই মানুষটারই আড়ালে আদত মানুষটা কি একই, নাকি অন্য কোনো কারণে সে পাগল সেজে আছে? মনরোগ বিশেষজ্ঞরা কীভাবে মানসিক অসুস্থতা নির্ণয় করেন, এই প্রশ্ন কখনও মনে এসেছে? এ-প্রশ্ন আমার আপনার মাথায় না আসুক, এসেছিল ডক্টর ডেভিড রসেনহানের মাথায়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনোবিদ রসেনহান এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলেন তাঁর পরীক্ষায়। যা বিখ্যাত ‘রসেনহান এক্সপেরিমেন্ট’ নামে।

কী সেই পরীক্ষা? ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে রসেনহান সহ আরও সাত জন ছদ্মবেশ ধরে আমেরিকার বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন তিনজন মহিলা ও চারজন পুরুষ সহ রসেনহান নিজে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাঁরা প্রত্যেকেই মানসিক অসুস্থতার ভান করেন। প্রত্যেকেই নিজেদের নাম ও পেশার বিষয়ে ভুল তথ্য দেন এবং বলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অদ্ভুত শব্দ শুনতে পান। কেউ যেন তাঁদের কানে কানে ফিসফিস করে ‘empty’ ও ‘hollow’ বলে। কিন্তু এই দুটি শব্দই তাঁরা কেন উল্লেখ করলেন? কারণ এ-দুটি শব্দ শূন্যতাকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ তাঁরা যে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন তা সহজেই প্রমাণ করা যাবে। আশ্চর্যজনকভাবে, কোনোরকম পরীক্ষা না করে শুধু রোগীদের দেওয়া এই তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁদের ভর্তি নিয়ে নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে রসেনহান লিখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি যে তাঁরা এত সহজে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন।

তাঁরা প্রত্যেকেই সুস্থ হলেও, তাঁদের মধ্যে সাতজনেরই স্কিজোফ্রেনিয়া আছে বলা হয় ও অন্য একজনের ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস বা বাইপলার ডিসঅর্ডার আছে বলা হয়। ওই সমস্ত রোগীদের মধ্যে কেউই শব্দভ্রম ছাড়া আর কোনো লক্ষণের কথা বলেননি। পরীক্ষার শুরুতে তাঁদের ভাবনা ছিল যে, তাঁদের হয়ত ভণ্ড বলে ধরে ফেলা হবে ও তাঁরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বেন। কিন্তু ডাক্তার নার্স কেউই তাঁদের ধরতে পারেননি। উল্টে তাঁরা যখন বললেন যে তাঁদের আর শব্দভ্রম হয় না, তাঁদের তবু ছাড়া হয়নি হাসপাতাল থেকে। বরং তারা ব্যক্তিজীবনের সঠিক তথ্য দিলেও তাতে ভরসা করেননি কেউই। কিন্তু ডাক্তার-নার্সরা ধরতে না পারলেও, হাসপাতালে ভর্তি থাকা ১১৮ জন রোগীর মধ্যে ৩৫ জন রোগী তাঁদের সরাসরি বলে বসেন, ‘আপনারা মোটেই অসুস্থ নন। বরং কোনো সাংবাদিক বা অধ্যাপক।’ ৭ থেকে ৫২ দিন পর ওই সমস্ত রোগীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। রিলিজের সময় এই হাসপাতালের পক্ষ থেকে এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, রোগীদের সমস্যা এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু মুক্তির শর্ত হিসেবে তাঁদের অ্যান্টি সাইকোটিক ড্রাগ সেবন করতে হয়েছিল।

এই পরীক্ষা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের দক্ষতাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে। তবে অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের দাবি, ছদ্ম রোগীরা নিজেদের বিষয়ে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্যই এমন হয়েছে। তবে একই পরীক্ষা করে অনেক মনোবিদ রসেনহানের মতই ফলাফল পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নিলি ব্লাই-এর ‘Ten Days In a Hospital’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। তবে এই পরীক্ষার ফলে আমেরিকার মানসিক সুস্থতা বিষয়ক পরীক্ষার অনেক পরিবর্তন আসে। নিয়ম জারি হয় – শুধুমাত্র একটি লক্ষণ নয়, বরং একাধিক লক্ষণ নজরে এলে তবেই কোনো ব্যাক্তিকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া যেতে পারে। রসেনহানের এই প্রসঙ্গে বক্তব্য ছিল, ‘It is clear that we cannot distinguish the sane from the insane in psychiatric hospital.’ সভ্যতা ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে হয়তো একদিন এর উপায়ও বেরোবে। তবুও মূল প্রশ্ন থেকেই যায়। মানসিক অসুস্থতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তাররাও কি যথেষ্ট পারদর্শী?