প্রথমে অপহরণ, তারপর বলপূর্বক বিয়ে দেওয়া – মেয়েদের সঙ্গে এমন বর্বরতাই ‘প্রথা’ এই দ্বীপে

পড়াশোনা করে বাড়িতে বসেছিলেন। চেষ্টা করছিলেন কাজ খোঁজার। একসময় স্থানীয় দুজন লোক কাজের যোগাযোগ নিয়ে তাঁর কাছে আসে। কিন্তু ঘর ছেড়ে দূরে যেতে হবে। একা মেয়ে, কিন্তু খেতেও তো হবে। আর মেয়েরাও তো কাজেকর্মে এগিয়ে আসছে। তাই তিনিও চলে গেলেন ওই লোকদুটোর সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁদের বক্তব্য, যার সঙ্গে আসল কথা বলা হবে, তিনি অন্য এক জায়গায় ব্যস্ত। সেখানে যেতে হবে তাঁদের। গাড়ির ‘বন্দোবস্ত’ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ শুরু হয় মেয়েটির। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উল্টো দিক থেকে অন্য একদল লোক এসে তাঁকে তুলে নিয়ে উঠে যায় সেই পূর্বনির্ধারিত গাড়িতে। মেয়েটির কাছে এবার পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি জানেন এরপর তাঁর সঙ্গে ঠিক কী ঘটতে চলেছে। বহু বছর ধরে এখানকার মেয়েদের সঙ্গে এই জিনিসটিই যে ঘটে চলেছে…

ব্যাপারটা খোলসা করা যাক। ইন্দোনেশিয়ার বালির পূর্বদিকের একটি দ্বীপ সুম্বা। আর সেখানেই বহু বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে একটি অদ্ভুত প্রথা— কাউইন তাংগকাপ। সহজ ভাষায় বললে অপহরণ করে জোর করে একটি মেয়ের বিয়ে দেওয়া। ওপরের বর্ণনাটি একটি বাস্তব উদাহরণ। আজও এই প্রথাটি চলে আসছে সেখানে। ইন্দোনেশিয়ার প্রশাসন থেকে শুরু করে নারী সুরক্ষা কমিশন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রত্যেকে এই প্রথাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে। তবুও সুম্বা দ্বীপের বেশ কিছু জায়গায় এই প্রথা চলছে। সম্প্রতি বেশ কিছু ভিডিও সামনে আসার পর সব মহল নড়েচড়ে বসেছে। 

প্রথাটির আরেকটু গভীরে ঢোকা যাক। কাউইন তাংগকাপ প্রথাটির সঙ্গে জড়িত আছে এক বিশেষ ধরণের গোষ্ঠীর নাম, যাকে স্থানীয়রা মারাপু বলে। অনেকটা পুরোহিতদের ভূমিকাই পালন করে; বলা ভালো তার থেকেও বেশি কিছু। প্রাচীনকাল থেকে এই গোষ্ঠীরা এখানে বসবাস করে আসছে। প্রথমত বিয়ের জন্য মেয়েকে অপহরণের সমস্ত আয়োজন এরাই করে। তারপর সুম্বাদের ট্র্যাডিশনাল ঘরে গিয়ে রীতিমতো বন্দি করে রাখা হয়। উল্লেখ্য, এই গোষ্ঠীর রীতি অনুযায়ী, যদি এইরকম ঘরে থাকাকালীন কারোর কপালে জলের ফোঁটা পড়ে, তাহলে সে ঘর থেকে বেরোতে পারবে না। তাকে সেখানে থাকতেই হবে। আর বন্দি অপহৃত মেয়েটির সঙ্গে সবার আগে ওটাই করা হয়। এতদিনের প্রথা অমান্য করার সাহস অধিকাংশই দেখাতে পারে না। এইভাবেই চলতে থাকে বর্বর প্রথা। 

এই প্রথার ইতিহাস দেখলে সাম্প্রতিক সময় মাত্র তিনজন নিজেদের মুক্ত করে পালাতে পেরেছেন। তাও অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের সহায়তায়। হয়ত আরও অনেকে চেষ্টা করেছিলেন কোনো না কোনো সময়। তাঁদের সঙ্গে কী হয়েছে, কেউ জানে না। সেই তিন মহিলার বক্তব্য, সবাই মেনে নেয়, কারণ সেটা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়। যেখানে নিজের ইচ্ছা বলে কিছু থাকে না। সব সময় চাপ দিয়ে রাখা হয়। 

এমন খবর সামনে আসার পর ইন্দোনেশিয়া সরকার নড়েচড়ে বসেছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নারী সুরক্ষা সংগঠন-সহ বিভিন্ন সংস্থা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এই বর্বর, ঘৃণ্য প্রথা নিষিদ্ধ করতে সমস্ত রকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে এগিয়েছে সরকার। তবুও থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। বিশ্বের অনেক দেশেই এরকম অনেক আইনই আছে। তবুও কুপ্রথা কি বন্ধ করা গেছে? ভারত থেকে বাল্য বিবাহ কি বন্ধ করা গেছে? লাভ জিহাদের নামে এখনও মানুষ খুন করা হয়। গায়ের রংয়ের ওপর ভিত্তি করে ভেদাভেদ তৈরি করা হয়। মেয়েদেরকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয় না। সেসবও তো আইনত নিষিদ্ধ। তবুও আওয়াজ তোলা জরুরি বলে মনে করছেন সবাই। সবকিছু নিয়েই আওয়াজ তুলে যাবেন তাঁরা। দিনের শেষে সেই আশার আলোই দেখিয়ে যাবেন মানুষকে। 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অধিকার বোঝাতে নারীর সিঁথি চিরে দিত পুরুষ; সিঁদুর বহন করছে সেই বর্বরতার ইতিহাসই

More From Author See More