প্রতিবছর বিশ্বে যৌনাঙ্গ অপসারণের শিকার অসংখ্য মহিলা, ভারতেও প্রচলিত ছিল এই ঘৃণ্য প্রথা

ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (FGM) বা নারী খৎনা। মহিলাদের যৌনাঙ্গ আংশিক বা পুরোপুরিভাবে কেটে ফেলার এক বর্বর প্রথা। প্রথমবার শুনে গা ঘিন ঘিন করে উঠছে? সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই ঘৃণ্য চর্চার শিকার হন কয়েক লক্ষ নারী। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতি ২০ জন নারীর মধ্যে ১ জনের অভিজ্ঞতা রয়েছে এই প্রথার।

এই রীতির যে কোনো চিকিৎসাগত যৌক্তিকতা নেই, সে কথা বার বার বলেছেন বিশ্বের বহু চিকিৎসক। তবুও দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর নানান দেশে চলে আসছে এই প্রথা। কোথাও বা সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়েছে এফজিএম। ধর্ম, পরিচ্ছন্নতা, উচ্ছৃঙ্খলতা প্রতিরোধ, যৌন পরিতৃপ্তি, সাবালিকা হয়ে ওঠার মতো নানান ভিত্তিহীন মতবাদ উঠে এলেও প্রধান কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক জায়গাতেই পণের মতো অন্যতম বিবাহশর্ত কুমারিত্ব। আর তার জন্যই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পারিবারিক কিংবা সামাজিক চাপে বাধ্য হয়েই এমন ভয়ঙ্কর পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই যেতে হয় মেয়েদের।

কীভাবে কার্যকর হয় এই প্রথা? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানাচ্ছে, মূলত চারটি প্রকারে সম্পন্ন হয় নারী লিঙ্গচ্ছেদের ঘৃণ্য এই ঘটনা। ক্লিটোরিস বা যৌনাঙ্গের অগ্রভাগ অপসারণ, এর প্রথম ধরন। দ্বিতীয় ধরনে, সম্পূর্ণ ক্লিটোরাসের অপসারণের সঙ্গে আংশিক বা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয় লেবিয়া মাইনরা। তৃতীয়টি সব থেকে ভয়ঙ্কর। পরিচিত ইনফিবিউলেশন নামে। যৌনাঙ্গের বাইরের অংশ পুরোপুরিই কেটে ফেলা হয় এতে। তারপর যোনিদ্বার সেলাই করে দেওয়া হয় বাইরে থেকে। প্রস্রাব এবং ঋতুস্রাবের জন্য রাখা হয় ছোটো একটি ফাঁক। এফজিএম প্রথার শিকার হওয়া মহিলাদের ১৫ শতাংশই ইনফিবিউলেশনের মধ্যে দিয়ে যান। চতুর্থত, এই সবগুলি পদ্ধতির বাইরে যৌনাঙ্গে নানাভাবে ক্ষত তৈরি করা হয়। কখনো ফোটানো হয় সূচ, কখনো কেটে প্রসারিত করা হয় যোনিদ্বার। অনেক সময় পুড়িয়েও দেওয়া হয় যৌনাঙ্গের বাইরের অংশ।

অধিকাংশ সময়েই ঘরোয়া পদ্ধতিতেই এই ধরণের অস্ত্রোপচার  করা হয়। ব্যবহার করা হয় না কোনো অনুভূতিনাশক। চিকিৎসক নয়, এই কাজে পারদর্শী আঞ্চলিক মহিলারাই অস্ত্রোপচার করে থাকেন। যৌনাঙ্গ অপসারণের পর যাতে মেয়েটি নড়া-চড়া না করতে পারে তার জন্য, হাত-পা বেঁধে রাখা হয় দু’ থেকে তিন দিন। তবে ক্ষতস্থান শুকাতে সময় লেগে যায় দু’ সপ্তাহ থেকে দেড় মাস অবধি। শুধু প্রক্রিয়াকালীনই নয়, এই মহিলাদের সারা জীবনই অসহ্য যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই কার্যত নরকবাস করতে হয় যৌনাঙ্গ অপসারণের পর। কখনো যৌনাঙ্গ অপসারণের সময় নেমে আসে মৃত্যুর ছায়াও। বেঁচে গেলেও চরম সম্ভাবনা থাকে সংক্রমণের। সেই সঙ্গে বয়স বাড়ার পাশাপাশি দেখা দেয় ব্লাডার, মূত্রনালি, কিডনির নানান সমস্যা ও গর্ভধারনে অক্ষমতা। বিবাহ পরবর্তী সময়ে যৌন মিলনের পরে অনেক ক্ষেত্রেই আবার অস্ত্রপ্রচার করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের সময় এফজিএম আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায় শিশু এবং মা উভয়েরই। 

প্রতিবছর অন্তত ৩ লক্ষ মহিলাকে সম্মুখীন হয় এই পাশবিক পর্যায়ের। পরিসংখ্যার বিচারে এই প্রথার শিকার পৃথিবীর প্রায় ২০ কোটি মহিলা। মূলত আফ্রিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের ২৯টি দেশ এবং এশিয়ার কিছু অংশ এবং অস্ট্রেলিয়ায় কিছু দেশে প্রচলিত এই রীতি। তবে ভয়ঙ্কর রকমভাবে এই প্রথার প্রচলন রয়েছে সোমালিয়া, গিনিয়া, সুদান, গাম্বিয়া, মালি, মিশর, সিয়েরা লিয়ন, এরিট্রিয়া এবং ইথিওপিয়ায়। সোমালিয়া ও গিনিয়ায় যথাক্রমে শতকরা ৯৮ ও ৯৭ শতাংশ মহিলাই শিকার এই প্রথার। সুদান এবং মিশরে এই হার ৮৭ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই রীতির প্রচলন থাকলেও আমেরিকা এবং ইউরোপেও বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। 

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৩ অব্দের মিশরীয় প্যাপিরাসে উল্লেখ আছে এই রেওয়াজের। ফ্যারাওদের শাসনকালে এই প্রথায় ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল সমগ্র মিশরকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই চর্চা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে। ছড়িয়েছে মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও। যদিও কোনো ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই এই প্রথার সম্পর্কে সংশ্লিষ্টতা নেই।

এফজিএমের প্রথম প্রচলনের সাক্ষী যেমন মিশর, তেমন মিশরেই প্রথম প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল এই প্রথার বিরুদ্ধে। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২০-তে। তবে বন্ধ হয়নি আজও। ২০০৫ সাল থেকেই অফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার কমিশনের তৎপরতায় ২৪টি দেশেই নিষিদ্ধ হয়েছে এই প্রথা। ২০১৪-তে এই রীতির বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল নাইজেরিয়া। কিছুদিন আগেই মে দিবসের দিন সুদানেও আইনত দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করা হয় নারী খৎনাকে। কিন্তু এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন তৈরির বিরুদ্ধে একাধিক দেশে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, প্রথা বন্ধ হলে বিবাহ সমস্যায় পড়তে পারে যুবতীরা।

আরেকটি তথ্য শুনলে শিউরে উঠবেন আপনিও। এফজিএমের এই জান্তব প্রথা থেকে মুক্ত ছিল না ভারতবর্ষও। অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি। না, কোনো পুরাতাত্ত্বিক যুগে না। এই একবিংশ শতাব্দীতেও। 

২০১৬ সালে মাসুমা রানালভি নামের বছর পঞ্চাশের এক মহিলার উদ্যোগে একটি পিটিশন জমা দেওয়া হয় মহারাষ্ট্রে। ওই মহিলা ১২ বছর বয়সেই শিকার হয়েছিলেন এফজিএমের। এই ঘটনার পরই সরব হন উদয়পুরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা জেনাব বানো-ও। তিনিও সাক্ষী এই পাশবিকতার। সেখান থেকেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। রানালভি জানান, ভারতের দাউদি ইসমালিয়া বহরা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত আছে এই প্রথা। রাজস্থান, দিল্লি, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে এই ঘৃণ্য অনুশীলন হয়। ভারতে এই সম্প্রদায়ের ২ লক্ষ মহিলার ৯০ শতাংশেরই অভিজ্ঞতা আছে এই বীভৎসতার। এবং আশ্চর্যজনকভাবেই এই পুরো প্রক্রিয়াটি সামাজিকভাবে অত্যন্ত গোপন রাখা হয়। ২০১৭ সালেও কেরালায় এফজিএমের একটি ঘটনা সামনে আসে। শুধু শারীরিক যন্ত্রণা নয়, মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ওই কিশোরী। 

২০১৭-র মে মাসে দিল্লির এক অ্যাডভোকেট, সুনিতা তিওয়ারি এফজিএম নিষিদ্ধ করার দাবিতে পিটিশন জমা দেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট দ্বারস্থ হয়েছিল কেন্দ্র এবং ওই চার রাজ্যের সরকারের কাছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রায় প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। নতুন করে কোনো আইন তৈরি না করলেও, ২০১২-পকসো আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই প্রথাকে। পরবর্তী সময়ে দাউদি বোরহা মুসলিম ওম্যান’স অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি সংস্থা এই প্রথার পক্ষে সওয়াল তুলেছিলেন। বক্তব্য ছিল আইনে ধর্মীয় স্বাধীনতা খণ্ডন করা হচ্ছে। পাশাপাশি লিঙ্গবৈষম্যের কথাও তুলে এনেছিল এই সংস্থা। দাবি করা হয়েছিল পুরুষের ক্ষেত্রে খৎনার প্রচলন থাকলে, নারীর থেকে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া অর্থহীন। তাই বলাই বাহুল্য, এই প্রথার প্রচলন ভারতে যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এমনটা হয়তো না। এখনো অজান্তেই হয়তো শিকার হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। অধিকাংশ সময়ই নির্যাতিতা প্রকাশ্যে আসেন না। ফলে মূল পরিসংখ্যান অধরা থেকে গেছে আজও।

এক শতাব্দী ধরেই এই বীভৎসতার বিরুদ্ধে অক্লান্ত লড়াই চলছেই। চলছে শিক্ষাদান, সচেতনতামূলক কর্মসূচি। কিন্তু তারপরেও দুর্দশা কাটেনি মহিলাদের। লকডাউনের এই সময়ে সোমালিয়ায় অসম্ভব রকমভাবে বেড়ে গিয়েছে এই প্রচলন। ১৫ বছরের কম বয়সী মহিলারা এই প্রথার শিকার হয়েছেন আগের থেকেও ৪৬ শতাংশ বেশি। নাইজেরিয়া, সুদানের নারীদের মুক্তি মিললেও এখনো অন্ধকারে বহু দেশ। এই নির্যাতন ও বর্বরতার শেষ ঠিক কবে, তা কারোরই জানা নেই...

ঋণ স্বীকারঃ

১. No new law for now, it is POCSO and IPC to curb FGM : INDIA TODAY, 30th July 2018
২. Waging a legal battle to ban FGM : The Hindu, May 11 2017
৩. প্রত্যূষা সরকার
৪. Pri.org
৫. who.int (World Health Organization Official Site)
৬. A conversation on the forbidden topic of FGM with Masoom Ranalvi : The Hindu, 21st October 2017

Powered by Froala Editor

More From Author See More