তাঁর সঙ্গে সমার্থক পঞ্জি স্কিম, প্রয়াত একুশ শতকের ‘সেরা’ প্রতারক বার্নার্ড ম্যাডফ

পঞ্জি স্কিম। কথাটার সঙ্গে  আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর পরিচিত। স্বল্প সময়ে দ্রুত অর্থ উপার্জনের এক ভুয়ো চক্রই হল পঞ্জি স্কিম। আসলে এই প্রতারণাচক্রে শুধু লাভবান হন মূল পরিকল্পনাকারীরাই। বিনিয়োগকারীরা তুরুপের তাস মাত্র। ওভারল্যান্ড থেকে সারদা— সবটাই এই অবৈধ ‘ব্যবসা’-রই উদাহরণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্জি স্কিম ও বার্নার্ড ম্যাডফ— এই দুটি শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। এই শতাব্দীরই প্রথম দশক। একটা গোটা আর্থিক ব্যবস্থাকে ধরে পড়তে দেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার নেপথ্যে ছিল ক্যারোলিনার লগ্নিদানব বার্নার্ড ম্যাডফ।

গত পরশু যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারাল কারাগারেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই শতাব্দীর সব থেকে বড়ো প্রতারক। ২০০৯ সাল থেকেই কারাবন্দি ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে শারীরিক অবস্থারও অবনতি হয়েছিল বেশ। আক্রান্ত হয়েছিলেন কিডনির সমস্যায়। তবে বার বার জামিনের আবেদন করলেও অনুমতি দেয়নি মার্কিন বিচার ব্যবস্থা। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্যও মেলেনি ছাড়পত্র। শেষ পর্যন্ত ৮২ বছর বয়সে এসে পৃথিবীকে বিদায় জানালেন ম্যাডফ।

১৯৩৮ সালে নিউইয়র্কের কুইনস-এ এক ইহুদি পরিবারে জন্ম ম্যাডফের। বাবা ছিলেন সামান্য ছুতোর মিস্ত্রি। শরণার্থী হিসাবেই পোল্যান্ড থেকে মার্কিন প্রদেশে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়েছিলেন তিনি। নতুন দেশ, নতুন শহর। কাজেই অর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে অসম সম্মুখ সমরে নামতে হয়েছিল প্রথম থেকেই। তবে দারিদ্রের ছায়ায় থেকেও কোনোভাবে ফাঁক রাখেননি সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে। ম্যাডফ ব্রুকলিন ল’ স্কুল থেকে স্নাতকতা সম্পূর্ণ করেন আইনে। অন্যদিকে ভাই পিটার রাজনীতিবিদ্যার স্নাতক।

ম্যাডফের অবৈধ ব্যবসা শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। কলেজ পাশ করার পরই ‘বার্নার্ড এল ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিজ’ প্রতিষ্ঠা করেন বার্নি। নিজের সামান্য সঞ্চয়। আর বাকি প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ পুরোটাই শ্বশুরের থেকে ধার করা। তবে শুরুতে বিশ্বাস অর্জনের জন্য খানিকটা নৈতিক পথেই হেঁটেছিলেন বার্নার্ড ম্যাডফ ওরফে বার্নি। সেসময় বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে পেনি স্টক নিয়েই মূলত ব্যবসা চালাতেন তিনি। 

আরও পড়ুন
চুরি হয়ে যাওয়া সামগ্রী থেকেই তৈরি হচ্ছে আফগানিস্তানের নতুন ইতিহাস

তবে নিজের ব্যবসার ভিদ পাকা করতে বেশি সময় লাগেনি। কথা ফাঁদ আর মিষ্টতায় তাঁর প্রথম বড়ো শিকার হন মার্কিন ব্যবসায়ী কার্ল সাপিরো। বিনিয়োগ করেন ১ লক্ষ মার্কিন ডলার। আর তারপরেই ক্রমশ শাখা-প্রশাখা বাড়তে থাকে বার্নির এই ব্যবসার। ঠিক যেভাবে অন্যান্য পঞ্জি স্কিম ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে। ঠিক সেভাবেই। বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে তাঁদের পরিচিত ও বন্ধুরা বার্নির এই প্রতারক সংস্থার নতুন সদস্য হয়ে উঠতেন। আর নতুন কোনো বিনিয়োগকারী খুঁজে এনে দিতে পারলে বেশ ভালো অঙ্কের বোনাসও দেওয়া হত তাঁদের। ফলত বেশ রমরমিয়েই চলতে থাকে ব্যবসা।

তবে ম্যাডফের এই সংস্থা থেকে কি কিছুই ফেরত পাননি বিনিয়োগকারীরা? একেবারেই তেমনটা নয়। বরং শুরুর দিকে যেসব বিনিয়োগকারী তাঁদের লগ্নি ফিরিয়ে নিয়েছেন, তাঁরা ব্যাপক লাভবান হয়েছেন ম্যাডফের থেকে। আসলে বিশ্বাস অর্জনের জন্যই এমন চাল চেলেছিলেন ম্যাডফ। কিন্তু কোথা থেকে আসত সেসব টাকা? তদন্ত বলছে, নতুন লগ্নিকারীদের অর্থ থেকেই পুরনো বিনিয়োগকারীদের সুদে-মূলে হিসাবে মেটাতেন বার্নি। এবং এই লাভ দেখেই বড়ো অঙ্কের টাকা দীর্ঘ মেয়াদে রাখা শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি আইনি স্বচ্ছতার প্রমাণস্বরূপ বহু ভুয়ো ফান্ড তৈরি করেছিলেন তিনি খাতায়-কলমে। মার্কিন শেয়ারে তাদের কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব না থাকলেও, কেবলমাত্র লগ্নিকারীদের কাছেই পেশ করা হত তা। অন্যদিকে তাঁর গ্রাহকের তালিকায় ছিলেন পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ, অভিনেতা কেভিন বেকনের মতো তারকারা। ফলে তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই এগিয়ে আসত সাধারণ মানুষ। আর ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে পড়েছিল পাঁচটি মহাদেশে!

আরও পড়ুন
ব্রাহ্মণ হয়েও অর্থনীতির চর্চা, সামাজিক সব গণ্ডি ভেঙে দিয়েছিলেন ভরদ্বাজ

ম্যাডফ-দুর্গের ভাঙন ধরে এই শতকের একেবারে শুরুর দিক থেকেই। ২০০০ সালের প্রথম থেকেই একের পর এক অভিযোগ উঠতে শুরু করে ম্যাডফের এই সংস্থার বিরুদ্ধে। তবে এমনই এক সাফল্যের প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছিলেন ছিলেন যে, সেই অভিযোগে কর্ণপাতও করেনি মার্কিন প্রশাসন। তবে ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনের ঠিক আগেই নড়ে চড়ে বসে জর্জ বুশের শাসন-ব্যবস্থা। ততদিনে মার্কিন অর্থনীতিতে বড়োসড়ো ধ্বস নেমেছে। ফলত দাবি ওঠে তদন্তের। ম্যাডফের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও স্কিম নিয়েও শুরু হয় চিরুনি চল্লাশি। এমনকি ম্যাডফের বাড়িতেও হানা দেয় এফবিআই ও ইআইসি।

অন্যদিকে তখন ম্যাডফের অফিসে হন্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী। অর্থনৈতিক মন্দায় তাঁরাও ফেরাতে চান নিজেদের লগ্নি। যার মোট মূল্য প্রায় ৮০০-১০০০ কোটি মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে প্রতারণাচক্র যে ফাঁস হতে চলেছে তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন ম্যাডফ। বাড়িতে এফবিআই-এর এজেন্টদের ডেকেই শেষমেশ পুরো বিষয়টি খোলসা করে জানান বার্নি।

আরও পড়ুন
১০০ বছর পর দেশে ফিরছে চুরি-যাওয়া অন্নপূর্ণা মূর্তি

তার পরেই গ্রেপ্তার। ঐতিহাসিক প্রতারণা মামলা শুরু হয় আদালতে। অবশ্য মামলা চলাকালীন বাড়িতেই গৃহবন্দি ছিলেন তিনি। সেসময় হঠাৎ করেই নাটকীয় পরিবর্তন দেখা দেয় পরিবারে। ব্যবসার অন্যতম অংশীদার তথা তাঁর ভাই পিটার দাবি করে বসেন, তাঁকে না জানিয়েই এই ধরণের অবৈধ ব্যবসার ফাঁদ পেতেছেন তাঁর দাদা। মার্ডফের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁর স্ত্রীও। এমনকি তিনি দাবি করেন গৃহবন্দি থাকাকালীন তাঁদের দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলেন তাঁরা।

২০০৯ সালের ১২ মার্চ। শেষ পর্যন্ত রায় দেয় আদালত। ১১টি প্রতারণার অভিযোগ স্বীকারও করে নেন বার্নি। সাজা হিসাবে নির্ধারিত হয় ১৫০ বছরের কারাবাস। পাশাপাশি তাঁর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করে মার্কিন প্রশাসন। দুটি বিলাসবহুল জাহাজ, প্রাইভেট এরোপ্লেন, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য, রাজকীয় প্রাসাদ, গ্যালারি, স্টেডিয়াম— বাজেয়াপ্ত হয় সব কিছুই। তা থেকেই প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে বিনিয়োগকারীরা যে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন এমনটা একেবারেই নয়। কারণ লগ্নির অধিকাংশ অর্থই বিলাসবহুল জীবনে খরচ করেন বার্নার্ড ম্যাডফ।

হিসেব বলছে, ৪০ বছরে জালিয়াতির কর্মকাণ্ডে তাঁর দেনার পরিমাণ ছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর, প্রতারণার পরিমাণ ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ম্যাডফ তো বটেই, মার্ডফের স্ত্রীয়েরও সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মার্কিন প্রশাসন। অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২৫ লক্ষ টাকার সম্পত্তি। এক ধাক্কায় স্বর্গ থেকে যেন মাটিতে নেমে এসেছিল জীবনযাপন। স্ত্রী রুথ মানিয়ে নিলেও, এই নতুন জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি মার্ডফের দুই সন্তানই। ২০১০ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন বড়ো ছেলে মার্ক। বছর চারেক বাদে মৃত্যু হয় ছোটো ছেলে অ্যান্ড্রু’র। পারিবারিক ধ্বসের সেই কফিনে শেষ পেরেকটা পড়ল বার্নির মৃত্যুতে। তবে শুধু নিজেই প্রতারণা করে যাননি বার্নার্ড। বরং এই বৃহত্তর প্রতারণা চক্রের বীজ রোপণ করে দিয়ে গেছেন বর্তমান সমাজে। অনৈতিক ব্যবসায়ীদের দেখিয়ে গেছেন প্রতারণার ছক। যা নির্মূল করার কোনো উপায়ই জানা নেই কারোর…

Powered by Froala Editor