ছাইঢাকা গোটা অঞ্চল, এন্নোর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণে বিপর্যস্ত গ্রামবাসীরা

উত্তর চেন্নাইয়ের এন্নোর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গোটা ভারতের কাছেই এক দৃষ্টান্ত দক্ষিণের এই পাওয়ার প্ল্যান্ট। উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং জ্বালানি হ্রাস করার জন্য তাদের ঝুলিতে রয়েছে একাধিক পুরস্কার। কিন্তু এসবের পিছনেই নির্দ্বিধায় পরিবেশের নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও কোনো সুফল না পেয়ে ক্ষুব্ধ এন্নোরের গ্রামবাসীরা।

এই সমস্যা অবশ্য আজকের নয়। চেন্নাইয়ের ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিগত কয়েক বছরে একাধিকবার উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে। গ্রিন ট্রাইবুনালে চলছে মামলাও। তবুও সমস্ত আইনি আদেশ সত্ত্বেও কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। 

চেন্নাইয়ের এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত নিকটবর্তী সেপক্কাম গ্রাম। এক সময় যেখানে বিঘার পর বিঘা জুড়ে ছিল ধানের ক্ষেত, এখন তা ধূসর প্রান্তর। ফ্লাই অ্যাশের মোটা আস্তরণ ঢেকে ফেলেছে গোটা অঞ্চলটাকে। দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে নিকটবর্তী নদীতে। জলাশয়গুলিতেও জমেছে পুরু লবণের আস্তরণ। সেইসঙ্গে বাতাসে মিশছে সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস। 

১৯৯৪ সালে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সময়ই সেপক্কাম গ্রামে কয়েক একর জমি কিনেছিলেন সংস্থাটি। প্রতি কাঠা পিছু গ্রামবাসীরা দাম পেয়েছিলেন মাত্র ৩৫ টাকা। চাকরির আশ্বাস দেওয়া হলেও, সেই সুযোগ থেকে এখনও বঞ্চিত তাঁরা। সেই আবাদযোগ্য জমির মধ্যেই সংস্থাটি তৈরি করেছিল তাঁদের ফ্লাই অ্যাশ ডাম্পিং গ্রাউন্ড। কারখানা থেকে দূষিত ছাই মিশ্রিত সমুদ্রের জল পাইপ লাইনের মাধ্যমে এসে জমা হয় সেখানেই। তবে নেই কোনো পরিশোধন প্ল্যান্টের ব্যবস্থা। অনুপস্থিত যথাযথ পরিকাঠামোও। ফলে দূষিত বর্জ্য সরাসরি মিশছে ভূগর্ভস্থ্য জলে। তাতে ক্যাডমিয়াম, লেড, পারদ, আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি স্বাভাবিকমাত্রার থেকে কয়েকগুণ বেশি। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে এখন বাইরে থেকে জল কিনে খেতে হচ্ছে গ্রামবাসীদের। অন্যদিকে দূষণের কারণে বিপর্যস্ত মৎস্যজীবীরাও।

আরও পড়ুন
ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির সমস্ত দূষণ শুষে নিতে পারে এই উদ্ভিদ!

এখানেই শেষ নয়, বর্ষা এলেই এই দূষিত জল প্লাবিত হয় গোটা গ্রামে। যার ফলে গ্রামবাসীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন চর্মরোগ। বিগত দু’বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে সিলিকোসিস, ব্রঙ্কাইটিস, টিউবারকিলোসিসের মতো রোগের আধিক্যও। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, প্রতি মাসেই এখন কমপক্ষে ২-৩ জন গ্রামবাসী আক্রান্ত হচ্ছেন এই ধরনের দুরারোগ্য রোগে। বিগত ২ বছরে সব মিলিয়ে শুধু টিবি আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫ জন মানুষ। 

আরও পড়ুন
দূষণমুক্ত বায়ুই বাড়িয়ে তুলেছে পৃথিবীর উষ্ণতা, চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল গবেষণায়

গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পর থেকে যন্ত্রাংশে আর কোনো বদলই করেনি সংস্থাটি। ফাটল ধরেছে পাইপলাইনে। সেখান থেকে ক্রমাগত দূষিত লবণাক্ত জল মিশছে চাষের জমিতে। স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের কাছে একাধিকবার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি কোনো। বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু ধর্মঘট ও প্রতিবাদেও সামিল হয়েছিলেন তাঁরা। দ্বারস্থ হন গ্রিন ট্রাইবুনালের। ফলাফল হিসেবে খাতায়-কলমে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে বদলায়নি পরিস্থিতি। গ্রিন ট্রাইবুনালের আধিকারিকরা ব্যবস্থাপনার জরিপ করতে এলে সাময়িক মেরামতেই আসল পরিস্থিতি ঢাকা দেন সংস্থার ব্যবস্থাপকরা। এমনটাই অভিযোগ স্থানীয়দের।

আরও পড়ুন
কলকাতা থেকে রিকশায় লাদাখ, দূষণমুক্ত পৃথিবীর লক্ষ্যে বিচিত্র অভিযান সত্যেন দাসের

সম্প্রতি নির্বাচনে জিতে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসে শপথ নিয়েছেন এম.কে. স্তালিন। গতকালই তাঁর কাছেই লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উচ্ছেদ চান না তাঁরা। পরিবেশ দূষণরোধে যাতে ব্যবস্থা নেয় সংস্থাটি, এটুকুই দাবি। এখন দেখার পরিস্থিতির সত্যিই কোনো বদল আসে কিনা। সেই সুবিচারের দিকে চেয়েই অপেক্ষা করে রয়েছেন স্থানীয়রা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More