শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কাণ্ডারী তিনি, প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রমানাথ রায়

উনিশ শতকের শুরু দিকে ইউরোপে জন্ম নেয় বাস্তববাদী শিল্পরীতি কিংবা রিয়ালিজমের। তার স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল বাংলাতেও। রবীন্দ্রনাথ কিংবা বঙ্কিম স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর তৈরি করতে পারলেও উনিশ কিংবা বিশ শতকের অধিকাংশ কথা সাহিত্যেই রয়ে গিয়েছিল রিয়ালিজমের ছাপ। তাই প্রচলিত বাস্তববাদী রীতিকে পাশে সরিয়ে রেখেই নতুন ভঙ্গির অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। জন্ম নিয়েছিল শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন।

রমানাথ রায়। শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী, গতকাল পাড়ি দিলেন অন্য ভুবনে। সন্ধে সাড়ে আটটা নাগাদ উত্তর কলকাতার নিজের বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। 

১৯৪০ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতা শহরে জন্ম রমানাথ রায়ের। পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের যশোরে। অল্প বয়স থেকেই ছোটো পত্রিকার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁর। তবে প্রচলিত পথে সাহিত্যের দিকে হাঁটলেন না তিনি। শুরু হল বিকল্পের অনুসন্ধান। বাস্তবের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নতুন ধারার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করালেন তিনি। গল্পের ধারার সঙ্গে মিলেমিশে গেল বিষয়বস্তু। 

না, সেখানে কোনো নির্ধারিত প্লট নেই। তাঁর বিশ্বাস প্লট সবসময়ই নির্মিত হয় কার্য-কারণের ওপর ভর করে। সুতরাং কোথাও যেন বেঁধে দেওয়া হয় তার পরিণতিকে। ঠিক সেই জায়গাটাতেই বিবর্তন আনলেন রমানাথ রায়। স্বতঃস্ফূর্ত লেখনীর মাধ্যমে একটা দর্শনকেই তুলে আনলেন তিনি। যেন ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া কিছু মুহূর্ত। তাদের সুনির্দিষ্ট পরিণতি নেই কোনো। যার শেষে রয়েছে শুধু বিস্ময়। কোথাও কোথাও স্বাভাবিক যুক্তি কিংবা বাস্তবতার সঙ্গে তার সংঘাত লাগতে বাধ্য। 

আরও পড়ুন
সাহিত্য অ্যাকাদেমি পাচ্ছেন শংকর

“কী লেখা হবে এবং কে লিখবে সেটা তৎকালীন একটি পত্রিকাই যেন ঠিক করে দিত। তার বিরোধিতা করা একজন লেখকের কর্তব্য। সেটাই করেছিলেন রমানাথ রায়রা। শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন বলতে সাহিত্যের যে নন্দন তত্ত্বকে কিন্তু অস্বীকার করতেন না। বাংলা সাহিত্যের যে বিস্তীর্ণ নদীর মতো ধারা, তার মধ্যে রমানাথ রায় একটা আলাদা জগৎ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর একটা নিজস্ব পথচলা ছিল। তাঁর গল্পের যে কন্টেন্টে, ফর্মে, প্রেসেন্টেশনে যে অভিনবত্ব ছিল, তার জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রমানাথ রায়ের একটা জায়গা থাকবে”, বললেন সাম্প্রতিক সময়ের কথাসাহিত্যিক কনিষ্ক ভট্টাচার্য।

তবে অনেকেই তাঁর সাহিত্য রচনার প্রেক্ষিতকে জাদুবাস্তব বলে থাকেন। এই প্রসঙ্গেই আরেক কথাসাহিত্যিক অনির্বাণ বসু জানালেন, “ম্যাজিকাল কিছু দেখে সেটাকেই ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে ভুল করি আমরা। জাদুবাস্তব মূলত ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার সাহিত্যের ধারা। তার প্রথম শর্ত হল ঔপনিবেশিক অবনমন। সেটা আমাদের এখানে সম্ভব নয়। আমরা শুধু রমানাথ রায়ের লিখনশৈলীটাকেই দেখি। তবে তাঁর গল্প নিয়ে কথা হলেও উপন্যাস নিয়ে একেবারেই কথা হয় না। অথচ তাঁর উপন্যাসে অদ্ভুত স্যাটায়ার রয়েছে। বিশেষত ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ কিংবা ‘কর্ণকাহিনী’। তবে তিনটি গল্পগ্রন্থ থাকলেও তাঁর লেখা অসংখ্য গল্প এখনও অগ্রন্থিত। সেগুলো যেন এক জায়গায় আসে তা আমি বার বার বলব। সবটা যেন পাওয়া যায় ভবিষ্যতে।”

আরও পড়ুন
প্রয়াত কিংবদন্তি বেহালাবাদক শিশিরকণা ধর চৌধুরী

‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ ছাড়াও ‘কাঁকন’, ‘অন্যায় করিনি’, ‘ভালোবাসা চাই’ ইত্যাদি বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তাছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘প্রিয় গল্প’, ‘দু’ঘণ্টার ভালোবাসা’। বাংলা সাহিত্যে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য পেয়েছেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার, বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার। শেষ বয়সেও লেখালিখির সঙ্গে এতটুকু সম্পর্কছিন্ন হয়নি তাঁর। গত বছর একাধিক পত্রিকার পুজোসংখ্যাতেও লিখেছেন তিনি। প্রায়ই যাতায়াত করতেন কলেজ স্ট্রিটে, কফি হাউসে। অথচ এমন প্রাণবন্ত মানুষ হঠাৎই থেমে যাবেন এভাবে, তা যেন জানা ছিল না কারোরই…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিক হিসাবে জাঁ-জ্যাকস রুশো ফেলোশিপ পেলেন বাংলার মনোরঞ্জন ব্যাপারী

More From Author See More