কঠিন সময়েও কাছে পাননি বাবাকে, লড়াই-এর মধ্যে দিয়েই হয়ে উঠলেন ‘দ্য রক’

উচ্চতা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। সেইসঙ্গে দৈত্যসম পেশিবহুল চেহারা। ফলত সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষকরাও দূরত্ব বজায় রেখেই চলত তাঁর সঙ্গে। কানাঘুষো খবর ঘুরে বেড়াত, আন্ডারকভার এজেন্ট তিনি। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। একদিন ভুলবশত ঢুকে পড়েন শিক্ষকদের ওয়াশরুমে। খানিক বকার ঢঙেই সেদিন তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন স্কুলের এক শিক্ষক জডি সুইক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন আকস্মিক বকায়, তর্ক জোড়ে ছেলেটিও। তবে খুব বেশি দূর এগোয়নি সেই বাক্যবিনিময়। রণমূর্তি দেখে রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন শিক্ষক স্বয়ং। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর কাছে ক্ষমা চান দশাসই চেহারার সেই যুবক। আর অদ্ভুতভাবেই তারপর পাল্টে যায় তার জীবন।

ডিউয়েন জনসন। এই নামের চাইতে অবশ্য ‘দ্য রক’ হিসাবেই সকলের কাছে বেশি পরিচিত তিনি। সারা পৃথিবীজুড়ে যাঁর ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার অনুরাগী, সেই রকই একদিন শিকার ছিলেন নিঃসঙ্গতার। দারিদ্রেরও। বাবার সঙ্গেও যেন গড়ে উঠেছিল দূরত্ব।

ক্যালিফোর্নিয়ার হেওয়ার্ডের এক রেসলার পরিবারে জন্ম রকের। বাবা রকি ‘সোলম্যান’ জনসন ছিলেন ডব্লুডব্লুএফ সুপারস্টার। আর সেই কারণেই তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হত সারা পৃথিবী। অন্যদিকে বারবার ঠিকানা পরিবর্তন করে শেষমেশ হনলুলুতে কিশোর ডিউয়েন-কে নিয়ে থিতু হন তাঁর মা। বাবার সফল কেরিয়ার সত্ত্বেও পরিবারে চেপে বসেছিল আর্থিক অনটন। মা সামান্য কাজ করতেন, তা দিয়ে কোনোরকম দিন কাটত তাঁদের।

কঠিন সময়েও বাবাকে পাশে না পাওয়ার ফলেই তাঁকে ঘিরে ধরেছিল হতাশা। অভিমানও কি ছিল না? তা সত্ত্বেও শরীরচর্চার ক্ষেত্রে বাবাকেই আইকন করে পথ চলা শুরু করেন ডিউয়েন। মনে করতেন শরীরচর্চাই একমাত্র সফলতার চাবিকাঠি।

আরও পড়ুন
স্কুলে ফেল করেছিলেন কেমিস্ট্রিতে, পরবর্তীকালে তিনিই রসায়নে নোবেলজয়ী!

তবে হনলুলুতেও বেশিদিন থাকা হয়নি তাঁর। ফিরতে হয়েছিল মার্কিন মুলুকে। তারপর স্কুলের সেই ঘটনা। আসলে ঠিক যেমনটা তাঁকে মনে করত সহপাঠীরা, শিক্ষকরা— মনের দিক থেকে একেবারেই তেমনটা ছিলেন না ডিউয়েন। যুবক ডিউয়েনের ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক নম্র, পরিশীলিত মানুষ। সেই মানুষটাকেই নতুন করে আবিষ্কার করেন স্কুলের শিক্ষক জডি সুইক। গড়ে ওঠে এক রূপকথার সম্পর্ক। পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকেই সন্তানসম স্নেহ পেয়েছেন ‘দ্য রক’।

আরও পড়ুন
পুলিশের চোখে ধুলো দিতে সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন বিপ্লবী উধম সিং

শুধু পড়াশোনাই নয়, ফুটবলেও ডিউয়েনের হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। তবে ভারতীয় ফুটবলের থেকে সেই ফুটবল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাগবি বলা চলে তাকে। হাইস্কুলে তাঁর অধীনেই ফুটবল খেলা প্রথম। শেখা খেলার ট্যাকটিক্স। শারীরিক গঠনের জন্য পাকাপাকি জায়গা করে নিতেও অসুবিধে হয়নি খুব কিছু। পরে মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি বৃত্তির সুযোগ পান এই ফুটবলের জন্যই। সেসময়ই কোচ ডেনিস ইরিকসনের নজরে আসেন তিনি। সুযোগ আসে এনএফএল খেলার। তবে চোটের জন্য হাতছাড়া হয় সে সুযোগ। শুরু হয় অবসাদের এক অধ্যায়।

ঠিক তার পরের বছরে কানাডিয়ান ফুটবল লিগে পেশাদারি ক্লাব ক্যালগরি স্ট্যামপেডারের চুক্তিতে সই করেন ডিউয়েন। তবে সেখানেও পিছু ছাড়েনি ভাগ্য। মূল দল থেকে তাঁকে সরিয়ে রেখেছিলেন ক্লাব-কোচ। সেটা ১৯৯৫ সাল। রাগে, দুঃখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফুটবল জীবনে ইতি টানার। পরে মূল দলে ডাক পেলেও আর মাঠের দিকে পা বাড়াননি। বেছে নিয়েছিলেন রেসলিংকেই।

আরও পড়ুন
অভিনয়ের জন্য বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে

চেহারার জন্য এক বাক্যেই ছাড়পত্র মিলল ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশনের। বাবার নামানুসারে ‘রকি মাইভিয়া’ ছদ্মনাম নিয়েই রিং-এ নামেন ডিউয়েন। এল সাফল্যও। তবে দর্শকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারলেন না তিনি। আসলে নম্র, শান্ত চরিত্রকে কি মানায় এমন রেসলিং রিং-এ? তাঁর এই ‘ভদ্র’ আচরণকে ঠিক নিতে পারেননি দর্শকরা। দর্শাকাসন থেকে উড়ে আসত খারাপ মন্তব্যও।

প্রাথমিকভাবে সেখান থেকেও তাই সরে আসার কথা ভেবেছিলেন তিনি। তবে ফারুও, ডি’লো ব্রাউন এবং কামারের সঙ্গে আলাপে সিদ্ধান্ত বদল করেন ডিউয়েন। ১৯৯৭ সালে ‘দ্য রক’ নামে তাঁর পুনর্জন্ম হয় ডব্লুডব্লুএফ-এ। যিনি সর্বাঙ্গেই পেশাদার একজন রেসলার। ‘দ্য অ্যাংরি ইয়ংম্যান’। পরের গল্পটা সকলেরই জানা। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রেসলার হয়ে ওঠা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। জিতেছিলেন বেল্টও। বেশ কয়েক বছর ধারাবাহিক ফর্মেই সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন ‘দ্য রক’-খ্যাত ডিউয়েন জনসন।

সেসময় থেকেই আসতে শুরু করে একের পর এক সিনেমার অফার। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে অভিনয়জগতে অভিষেক হয় ডিউয়েনের। ‘দ্য মমি’ সিনেমায় মুখ্য চরিত্র। তারপর ‘দ্য রান ডাউন’, ‘দ্য টুথ ফেয়ারি’, ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’, ‘স্করপিয়ন কিং’— একের পর এক হিট সিনেমা। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে হলিউডের ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র তারকাদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছেন তিনিই। বার্ষিক আয় ৮.৭৫ কোটি ডলার।

তবে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ছবি দেখলে মনে হবে, সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। ৩ কন্যাসন্তানের বাবা ডিউয়েন ছবির কাজ ছাড়া অধিকাংশ সময়টাই কাটান পরিবারের সঙ্গে। কখনও দেখা যায় মেয়েদের সঙ্গে খেলছেন তিনি। কখনো আবার তাদের চুল আঁচড়ে দিচ্ছেন, পরিয়ে দিচ্ছেন নেলপালিস। এসব খুচরো ছবির হদিশ পাওয়া যাবে তাঁর স্ত্রী লরেনের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে গেলেই। পিতাকে কাছে পাননি নিজে। তাই হয়তো সন্তানদের থেকে এতটুকু সরতে দেন না পিতৃত্বের ছায়া। ‘রাফ এন্ড টাফ’ দ্য রকের পিছনে লুকিয়ে থাকা নমনীয় সেই মানুষটা আসলে সকলেরই অজানা…

Powered by Froala Editor