শীতের শুরুতেও ব্যবসায় মন্দা, এ-বছর ঘরে-ঘরে পৌঁছবে না জয়নগরের মোয়া?

জন্মের ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে শতাব্দীর অবহেলায়। শোনা যায়, গ্রামের প্রান্তিক মানুষরা নাকি জমিদারকে না জানিয়েই বানিয়ে ফেলেছিলেন মোয়া। আর গোপনে গোপনে তা ছড়িয়েও পড়েছিল। জানতে পেরে জমিদার মশাই বেশ চটে গিয়েছিলেন। এ মোয়া ছেলের হাতের মোয়া নয়। খাঁটি কনকচূড় চালের খই আর নলেন গুড় দিয়ে বানানো জয়নগরের মোয়া। বাংলার মিষ্টির জগতে সে এক অতি পরিচিত নাম। শীতকাল পড়লেই মোয়ার জন্য জিভে জল এসে যায় বাঙালির।

আবারও এসেছে শীতকাল। খেজুরগাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে নলেন গুড় তৈরিও শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে মোয়া তৈরিও। কিন্তু এবারে যেন সবকিছুর বাজারই অন্যরকম। জয়নগরের বাবুদার দোকান নামে বিখ্যাত আশীর্বাদ সুইটসের কর্মচারী আব্দুল গফফরের গলায় তাই আক্ষেপের সুর। “স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। আগে এই সময় মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা আসতেন; মোয়া কিনে নিয়ে যেতেন। এখন বিক্রিই হতে চাইছে না।” বলছেন তিনি। ফুড লাভার্স ডেন সংস্থার সুপ্রিয় নস্কর বলছেন, “জয়নগর-মজিলপুর এলাকায় স্কুল-কলেজগুলো থেকেই ব্যবসা হয় সবচেয়ে বেশি। পৌরসভা এলাকা হওয়ায় এখানে স্কুল-কলেজের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।”

তবে জয়নগরের মোয়ার চাহিদা তো শুধু আঞ্চলিক নয়, সারা বাংলাতেই সমান জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানেও একইরকম মন্দা বাজার, বলছেন আব্দুল গফফর। তাঁর কথায়, “হাওড়া-শিয়ালদা ডিভিশনের স্টেশনের দোকানগুলো থেকে আগে প্রচুর অর্ডার আসত। কিন্তু এবছর তাঁরাও বলছেন, ব্যবসা চলছে না। তার উপর কাঁচামাল আনতেও সমস্যা হচ্ছে। লকডাউনের অজুহাতে কাজু-কিশমিশের দাম বেড়ে গিয়েছে। ট্রেন চলাচলও স্বাভাবিক নয়। ফলে গুড় আনতেও খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেক। আমরা দামও বাড়াতে পারছি না, আবার গুণমানের সঙ্গেও আপোস করতে পারছি না।”

আরও পড়ুন
কলকাতার বাজারে ঢুকল ইলিশ, রসনা পূর্তির অপেক্ষায় ভোজনরসিকরা

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক ঐতিহ্যই। একসময় এই জয়নগর অঞ্চল ছিল বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। নীলাচল যাওয়ার পথে এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। তখন থেকেই বৈষ্ণব আন্দোলনের জোয়ার উঠেছিল জয়নগর-মজিলপুর এলাকায়। শিবনাথ শাস্ত্রী, পণ্ডিত উমেশচন্দ্র দত্ত, ডাঃ নীলরতন সরকার, কালিদাস দত্তের মতো খ্যাতনামা মানুষ জন্মেছেন এখানে। আর তার সঙ্গে অবশ্যই জড়িয়ে গিয়েছে মোয়ার ইতিহাস। সঠিক জন্মসময় জানা না থাকলেও ১৯০৪ সালকেই মোটামুটি মোয়া তৈরির শুরু বলে ধরা হয়। সেই হিসাবে বয়স হল ১১৬ বছর। তবু দীর্ঘদিন মেলেনি জি-আই তকমাটুকুও। অবশেষে জয়নগর মোয়া নির্মাণকারী সোসাইটির একাধিক আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে মিলল জি-আই তকমা। “এর পরে অবশ্য ব্যবসা অনেকটাই বেড়েছে। জি-আই তকমা পাওয়ার পর বাংলার বাইরেও চাহিদা বেড়েছে।” বলছিলেন জয়নগর মোয়া নির্মাণকারী সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অশোক কয়াল। কিন্তু সবকিছুতেই থাবা বসিয়েছে করোনা ভাইরাস। এই মহামারী পেরিয়ে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আবারও বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করবে জয়নগরের মোয়া; এটাই এখন আশা করছেন সকলে।

আরও পড়ুন
শুধু ফসল নষ্টই নয়, খাদ্য হিসেবে মানুষের রসনাও তৃপ্ত করে পঙ্গপালের দল

আরও পড়ুন
ঈদের দিন খাঁটি ঘিয়ে ভাজা সেমুই, রীতি আর রসনার অনবদ্য মিশেল

ছবিঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সুপ্রিয় নস্কর, ফুড লাভার্স ডেন

অশোক কয়াল, জয়নগর মোয়া নির্মাণকারী সোসাইটি

Powered by Froala Editor

More From Author See More