৩০ বছরের পরিশ্রমে গ্রামকে নতুন রাস্তা উপহার হরিহরের

সকাল থেকে চাষের মাঠের হাড়ভাঙা খাটুনি। অথচ তারপরেও বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই। দুই ভাই গাঁইতি, শাবল আর হাতুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পাহাড় কাটতে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই পাহাড় কেটে পথ বানাতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। সরকারি কর্তা এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও বলেছিলেন, প্রত্যন্ত এই গ্রামে পায়ে চলার মতো রাস্তা তৈরি অসম্ভব। তবু হাল ছাড়েননি ওড়িশার দুই ভাই হরিহর এবং ক্রুষ্ণা। বুঝেছিলেন, যা করার তা তাঁদেরই করতে হবে। আর এখন নয়গড় জেলার তুলুবি গ্রামে শুধু পায়ে চলার মতো পথ নয়, মোটরগাড়ি চলার মতো রাস্তাও তৈরি করে ফেলেছেন দুই ভাই। বলা ভালো, হরিহর একাই। কারণ দুজনে কাজ শুরু করলেও কয়েক বছরের মধ্যেই কিডনির অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ক্রুষ্ণা। ৩০ বছর ধরে একাই রাস্তা তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন হরিহর।

পাহাড়ের কোলে জঙ্গলে ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম তুলুবি। আপাতভাবে বেশ মনোরম মনে হলেও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা একেবারেই সহজ নয়। সামান্য বাজার করতেও শহরে যেতে হয়। অথচ এতদিন শহরে যাওয়ার জন্য কোনোরকম পায়ে হাঁটা পথও ছিল না। অতিথিদেরও গ্রামে আসতে গেলে পাহাড় পেরিয়ে আসতে হত। আর পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে অন্যান্য প্রাণীর উপদ্রবের পাশাপাশি সাপের ভয় পদে পদে। স্বাধীনতার পর থেকেই বারবার সরকারি কর্তাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সবাই এক কথায় বলেছেন, এখানে রাস্তা তৈরি অসম্ভব। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও কেউ গ্রামবাসীদের সমস্যার কথা কানে তোলেননি। ঠিক এই সময় হরিহর এবং ক্রুষ্ণা ঠিক করে নিলেন নিজের দায়িত্ব। দুজনেরই বয়স তখন সবে ২৫ পেরিয়েছে।

প্রথম প্রথম তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য কিছু হালকা বিষ্ফোরক ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু কয়েকবার ব্যবহার করেই বুঝতে পারেন, এতে জঙ্গলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই শেষ পর্যন্ত গাঁইতি, শাবল আর হাতুড়িকেই ভরসা করে নিলেন। কাজটা সহজ নয়। নেই কোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও। তবু হাল ছাড়ার পাত্র নন তাঁরা। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন ক্রুষ্ণা। কিডনির অসুখে ভুগে মারা গেলেন হরিহরের চোখের সামনে। এই ঘটনায় হরিহরের জেদ আরও বেড়ে গেল। বড়ো ভাইকে মৃত্যুর আগে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারেননি, কারণ শহরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। দ্বিগুণ পরিশ্রম শুরু করে দিলেন হরিহর। তাঁর সঙ্গে এগিয়ে এলেন বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীও। তবে মূল দায়িত্ব সবসময়ই হরিহরের উপর। মাত্র বছরখানেক হল সেই রাস্তা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যেই আশেপাশের বেশ কিছু গ্রাম থেকে সাহায্যের ডাক এসেছে হরিহরের কাছে। বহু গ্রামেই যে কোনো রাস্তা নেই। তবে হরিহরের একার নিষ্ঠায় টনক নড়েছে সরকারি কর্তাদেরও। নয়গড় জেলার সাব-কালেক্টর লগনজিৎ রাউত জানিয়েছেন, অন্যান্য গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব সরকারই নেবে। একজন মানুষ একক প্রচেষ্টায় যদি এত বড়ো কাজ করে ফেলতে পারেন, তাহলে সরকারের বিরাট পরিকাঠামোর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। এই বিষয়ে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথাবার্তাও শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও জানিয়েছেন রাউত।

Powered by Froala Editor

Latest News See More