শতবর্ষের ভয় ও একটি মুখ

বার্লিনের রাজপথে সেদিন মানুষের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সারাদিনের কাজ শেষ করে সবাই চলেছেন ‘নসফেরাতু’ নাট্যশালার দিকে। অদ্ভুত এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সেখানে। অনুষ্ঠানের নাম ‘আ সিমফনি অফ হরর’। আতঙ্কের ঐক্যতান। আর সেই অনুষ্ঠানেই প্রথম মানুষের সামনে জীবন্ত চেহারা নিয়ে হাজির হয় রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার। অবশ্যই তা নাটকের মঞ্চে এবং ভ্যাম্পায়ারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এফডব্লিউ মুরনাও।

ভ্যাম্পায়ার বললেই আমাদের যে নামটা মনে আসে, সেটা ড্রাকুলা। ব্র্যাম স্টোকারের বিখ্যাত উপন্যাসটিই প্রথম ভ্যাম্পায়ারের পূর্ণাঙ্গ চেহারা তৈরি করে। তবে আজকের ইন্টারনেটের যুগে তো বটেই, এর আগে নানা সংবাদপত্রে যে ছবিটা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটা কাউন্ট ওরকলের। কাউন্ট ড্রাকুলা থেকেই যে অনুপ্রাণিত কাউন্ট ওরকল, তাতে সন্দেহ নেই। আর এই চরিত্রটি জন্ম নিয়েছিল ১৯২২ সালের মার্চ মাসে বার্লিনের নসফেরাতু (Nosferatu) নাট্যশালায়।

কাউন্ট ওরকল চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে এফডব্লিউ মুরনাও-এর অবদান অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে চরিত্রটির জন্ম দিয়েছেন নসফেরাতু নাট্যশালার প্রযোজক আলবিন গ্রাউ। অকাল্টবিদ্যার ছাত্র আলবিন। নানা রকম অতিপ্রাকৃতিক চরিত্র নিয়ে তাঁর বিশদ গবেষণার কথা আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একটি সেনা ছাউনিতে তিনি ভ্যাম্পায়ারের দেখা পেয়েছেন। আর সেই ভ্যাম্পায়ারকেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কাউন্ট ওরকল চরিত্রটির ভিতর দিয়ে। এর সঙ্গে কাউন্ট ড্রাকুলার কোনো সম্পর্ক নেই।

কাউন্ট ড্রাকুলার সঙ্গে কাউন্ট ওরকলের চরিত্রের বৈসাদৃশ্য কম নয়। ড্রাকুলার ছিল মুখের দু-পাশে দুটি শ্বদন্ত। তবে কাউন্ট ওরকলের দাঁত ছিল ইঁদুরের মতো। আর ছিল মাথাভর্তি টাক। অবশ্য অনেক বিষয়ে সাদৃশ্যও ছিল। দুজনেরই কান ছিল কুকুরের মতো সূচালো। আর নাকও ছিল বেশ লম্বা। সব মিলিয়ে কাউন্ট ড্রাকুলার চেয়ে কাউন্ট ওরকল যে অনেক বেশি ভয়ানক চেহারার, তাতে সন্দেহ নেই। আর এই কারণেই কাউন্ট ড্রাকুলার উপরে ৩টি সিনেমা, এবং ড্রাকুলা অনুপ্রাণিত অসংখ্য সিনেমা তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেও ভ্যাম্পায়ারের দৃশ্যায়নে কাউন্ট ওরকলের মতো চেহারাই ফুটে ওঠে বারবার।

আরও পড়ুন
গল্পের নয়, রক্তের জন্য পাগল সত্যিকারের ড্রাকুলা থাকতেন এখানেই

মানুষ যে আতঙ্কিত হতে ভালোবাসে, কাউন্ট ওরকলের শতবর্ষের জনপ্রিয়তাই তা প্রমাণ করে। তবে তাকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। বিতর্কের কারণ সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই জার্মানিতে নাৎসি উত্থান শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতেই যখন কাউন্ট ওরকল আত্মপ্রকাশ করল, তখন অনেকেই এর পিছনে ইহুদি বিদ্বষের ছায়া দেখতে পেলেন। ওরকল নামটিও ইহুদি উপকথা থেকে নেওয়া। আর ইঁদুরের মতো দাঁতযুক্ত নানা চরিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে ইহুদি উপকথায়। তবে তারা কেউই ভয়ানক বা ক্ষতিকর চরিত্র নয়। ভ্যাম্পায়ারের মতো চরিত্রকে এভাবে গড়ে তোলার পিছনে তাই ইহুদি বিদ্বেষকেই দায়ী করেছেন অনেকে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ সেই অভিযোগ উড়িয়েও দিয়েছেন। এই অনুষ্ঠানের মঞ্চনাট্যরূপ লেখক হেনরিক গ্যালেন নিজে ইহুদি ছিলেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে বহু ইহুদি শিল্পী উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও

তবে বিতর্ক, সন্দেহ – সমস্তকিছুকেই ছাপিয়ে যায় ওরলকের জনপ্রিয়তা। প্রথম মঞ্চাভিনয়ের পর ১০০ বছর কেটে গিয়েছে। আজও ভ্যাম্পায়ারের চেহারা বলতেই উঠে আসে এক টাকমাথা, ইঁদুর দাঁতের ছবি। আজও মানুষকে একইভাবে ভয় দেখিয়ে চলেছে কাউন্ট ওরলক।

আরও পড়ুন
বইটিতে ফ্রানৎস কাফকা-কে তুলনা করা হয় ড্রাকুলা-র সঙ্গে!

Powered by Froala Editor