কবে থেকে ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতা? রয়েছে দীর্ঘ কাহিনি, বিতর্কও

বাংলা তো বইটেই, কলকাতাকে গোটা পূর্ব-ভারতের প্রাণকেন্দ্র বললেও ভুল হয় না এতটুকু। শিল্প-সংস্কৃতিই হোক কিংবা ঐতিহ্য— বর্ণময় এক ইতিহাসের সাক্ষী কলকাতা (Kolkata) নগরী। যার নামের সঙ্গে প্রায়শই জুড়ে যায় ‘সিটি অফ জয়’ (City Of Joy) শব্দবন্ধটি। বিশ্ববাসীর কাছে এটাই পরিচয় কলকাতার। কলকাতার উৎসব-মুখরতা, সংস্কৃতির সঙ্গে এই নাম যে মানানসই তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু কীভাবে জন্ম নিল এই নাম?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে আশির দশকে। ১৯৮৫ সাল। সেবছর প্রকাশিত হয়েছিল ফরাসি লেখক ডমিনিক লাপিয়েঁর লেখা একটি উপন্যাস— ‘লা সিটি ডে লা জোয়ে’। যার ইংরাজি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য সিটি অফ জয়’। হ্যাঁ, এই গ্রন্থের শিরোনামই হয়ে ওঠে কলকাতার ডাকনাম। 

লাপিয়েঁর এই গ্রন্থটির প্রেক্ষাপটই ছিল কলকাতা নগরী। না, কলকাতা বললে অবশ্য ভুল হবে খানিকটা। কলকাতার পার্শ্ববর্তী হাওড়ার স্টেশনের কাছে একটি বস্তির জীবনযাপনের ওপর ভিত্তি করেই আবর্তিত হয়েছে এই গল্পের প্রেক্ষাপট। আর সেই বস্তির নাম ‘আনন্দনগরী’। সেখান থেকেই গ্রন্থের শিরোনাম হয় ‘সিটি অফ জয়’। তবে এই উপন্যাস মোটে আনন্দময় কিংবা সুখকর নয়।

 

আরও পড়ুন
গায়ত্রী-আলাপনের বইপ্রকাশ, ব্যতিক্রমী সন্ধ্যার সাক্ষী কলকাতা

‘সিটি অফ জয়’ আশির দশকে লেখা হলেও, যে সময়কালের কথা বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থে, তখন ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব। আর কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতা তথা বাংলার সমাজে বৈষম্য তো ছিলই, একই সঙ্গে দৈনিক নিপীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হতে হত হাওড়ার এই বস্তির মানুষদের। পাশাপাশি ছিল কুষ্ঠের প্রকোপ। শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে ক্রমাগত অবহেলা এবং অস্পৃশ্যতায় মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন কুষ্ঠরোগীরা। এক কথায় বলতে গেলে কলকাতার এক অন্ধকার জগৎকেই তাঁর লেখায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন লাপিয়েঁ। খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই।

আরও পড়ুন
লেখকের পরিচয় গোপন, উপন্যাসের নামেই নামকরণ কলকাতার রাস্তার

গল্পটি আবর্তিত হয়েছে মূলত তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে— এক পোলিশ ধর্মযাজক, এক আমেরিকান চিকিৎসক ও একজন বাঙালি রিক্সাচালক। একাধিকবার উঠে এসেছে মাদার টেরেসার মিশনারি অফ চ্যারিটির কথাও। 

আরও পড়ুন
বিশ্বের প্রাচীনতম পোলো ক্লাব রয়েছে কলকাতাতেই, ধুঁকছে বিনিয়োগের অভাবে

দীর্ঘ সময় বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থের তালিকায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল ‘সিটি অফ জয়’। সেই সূত্রেই কলকাতার নামের পাশে পাকাপাকিভাবে বসে যায় ‘সিটি অফ জয়’ তকমাটিও। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ডমিনিক লাপিয়েঁর এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল একটি চলচ্চিত্রও। তার শ্যুটিং হয়েছিল কলকাতার বুকেই। অভিনেতাদের তালিকায় ছিলেন শাবানা আজমি, অমরেশ পুরির মতো তারকারা। তবে শ্যুটিং চলাকালীন সময় থেকেই একাধিকবার প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়েছিল চলচ্চিত্রের কলাকুশলীদের। পরবর্তীতে সিনেমাটির মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কলকাতা প্রেস এবং তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কলকাতা, বাংলা তো বটেই গ্রন্থটি প্রত্যেক ভারতীয়ের কাছেও অবমাননাকর বলেই অভিযোগ করেছিলেন তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। 

কলকাতার শরীরে কোনো ক্ষতদাগ নেই, এমনটা একেবারেই নয়। ঝাঁ চকচকে ভিক্টোরিয়ার শহরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দারিদ্র, রয়েছে একাধিক সমস্যা। তা সত্ত্বেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটায় তিলোত্তমা। খোলা হাতে স্বাগত জানায় সমস্ত সংস্কৃতির মানুষকেই। এই বৈচিত্র, ভিন্নতার সমাবস্থানই হয়তো আক্ষরিক অর্থেই আনন্দনগরী করে তোলে কলকাতাকে…

Powered by Froala Editor