আউশভিৎচ নিয়ে স্পিলবার্গের ছবিকে খারিজ করেছিলেন মাইকেল হানেকে

সাল ২০১২। হলিউড রিপোর্টারের তরফে আয়োজিত হয়েছিল একটি আলোচনা সভা। উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের প্রতিথযশা চলচ্চিত্রকারেরা। কথায় কথায় এসেছিল স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর বিশ্বখ্যাত এপিক ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবির প্রসঙ্গ। ‘এই ছবিটা আমি অন্তত সমর্থন করতে পারি না,’ ভুরু কুঁচকে বলেন অস্ট্রিয়া-র নির্মাতা মাইকেল হানেকে। ‘আউশভিৎচ নিয়ে স্পিলবার্গ যখন ছবি করছেন, তখন তাঁর মনে রাখা উচিত যে এটা সত্যি সত্যিই ইতিহাসে ঘটেছিল, এই নিয়ে আর যা হোক বাণিজ্যিক মেলোড্রামা করা যায় না।’

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (পঞ্চম পর্ব)

উপস্থিত অন্যেরা বেশ উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়েছেন প্রবীণ বক্তার দিকে। শান্ত সুরেই বলেন হানেকে, ‘আমার মনে হয় না আউশভিৎচ গণহত্যা নিয়ে খুব একটা ঠিকঠাক ছবি এখনও অবধি হয়েছে। একমাত্র অ্যালাঁ রেনে-র ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’ ছবিটা আমি যথার্থ মনে করি। আউশভিৎচ প্রসঙ্গে এই ছবিটাই সবচেয়ে দায়িত্বশীল, গুরুত্বপূর্ণও বটে।’     

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (চতুর্থ পর্ব)

কী ছিল অ্যালাঁ রেনে-র এই ছবিতে, যাকে ‘দায়িত্বশীল’ বলে সম্মান জানান হানেকে? সিরিয়াস ছবির দুনিয়ায় আজও আইকনিক অনধিক ৩০ মিনিটের এই তথ্যচিত্র। পরিচালক রেনে, যিনি চার বছর পরেই ফরাসি ‘নিউ ওয়েভ’ আন্দোলনের মুখ হিসেবে উঠে আসবেন, ১৯৫৬ সালে তুলেছিলেন ছবিটা। ছবিকে ভাগ করা হয় দুটি স্তরে। এক স্তরে ছিল আউশভিৎচ নিয়ে নাৎসিদের তোলা প্রচারমূলক ফুটেজ।  অন্য স্তরটি বোনা হয়েছিল অ্যালাঁ রেনেরই তোলা বর্তমান আউশভিৎচের ফুটেজ দিয়ে।  দু’টিকেই ইন্টার কাট ক’রে ছবি এডিট করা হয়, যার নেপথ্যে বেজে চলে পিয়ানোর একঘেয়ে সঙ্গীত এবং ভাষ্যকারের মৃদু গলা।

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (তৃতীয় পর্ব)

বর্ণনা শুনে বেশ সাদামাটাই লাগবে ছবিটাকে, যদিও বাস্তবটা হচ্ছে ভিন্ন। ...প্রথম দেখাতেই সাধারণ দর্শককে এতখানি ঝাঁকুনি আজ অবধি কম ছবিই দিতে পেরেছে।

নাৎসিদের ফিল্ম তোলা হয়েছিল সাদা কালোয়, পরিচালক রেনে আউশভিৎচের ছবি তোলেন রঙিন ফিল্মে। সাদা কালো ফুটেজে যা উঠেছিল, তার সবই ছিল আক্ষরিক অর্থেই ‘বাস্তব’, ইতিহাসে যার কথা আমরা অল্প বিস্তর সবাই পড়েছি। মধ্যযুগেও এই গ্রহ অনেক রক্তপাত দেখেছে, সেই অতীত-হিংসার সাক্ষ্য দিতে পারে কেবল লোকগাথা, পুঁথি, শিল্প কিংবা প্রত্ননিদর্শন। আধুনিক প্রযুক্তি কিন্তু উন্নততর সাক্ষীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে, ক্ষমতাবানের হাতে সে তুলে দিয়েছে সেরা অডিও-ভিশুয়াল মাধ্যম - ‘চলচ্চিত্র’। ১৯৪৪ সালে আউশভিৎচ-বুখেনভাল্ড ক্যাম্পে নাৎসিরা ঠিক কী কী করেছিল লক্ষাধিক ইহুদি জনতার সঙ্গে? ...সেসবের অনেক কিছুই ধরে রেখেছে সেলুলয়েড, আজকের হরর সিনেমা ধারে কাছেও আসতে পারে না যার।

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (দ্বিতীয় পর্ব)

মানুষের মাথার খুলি ঢেলে দেওয়া হচ্ছে পাত্রে, উলঙ্গ জনতাকে ছোটানো হচ্ছে, গণকবর দেওয়া হচ্ছে বুলেটে ঝাঁঝরা লাশেদের, গ্যাস চেম্বার থেকে বের করা হচ্ছে শয়ে শয়ে মৃতদেহ – সমস্ত দৃশ্যই সযত্নে রাখা ছিল জার্মানির চলচ্চিত্র আর্কাইভে। পাঠ্য বইতেই আমরা সেই বিবরণ পড়েছি এবং বারবার শিউরে উঠেছি। মানুষের চর্বি থেকে সাবান বানানো কিংবা চামড়া ছাড়িয়ে তা দিয়ে টেবিল ক্লথ তৈরি করা, কিছুই বাদ থাকেনি ছবিতে।

আরও পড়ুন
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে (প্রথম পর্ব)

এই দৃশ্যেরই সমান্তরালে পরিচালক বুনে দিয়েছেন আজকের কাঁটাতারে-ঘেরা  রিক্ত মৃত্যুশিবিরের ছবি। যেন বলতে চেয়েছেন, ‘চিনে রাখো এই জায়গাগুলো, কেননা এখানেই ঘটেছিল ঐ সত্যি ঘটনাগুলো। মানুষ এখানে সহমানুষকে মেরেছিল, জমে জমে পাহাড় হয়েছিল মৃত শিশুদের জুতো, নাৎসি-ডাক্তারের ঘরে সারি দিয়ে টাঙানো ছিল মনুষ্যদেহ। জড়বস্তু সেলুলয়েডের মতোই স্থান ও কাল ছিল সমান নির্বিকার, রক্ত আর অশ্রু যেখানে সমান মূল্যহীন।’

আরও পড়ুন
একটি ছবি, একটি সত্যি আত্মহত্যা এবং উনিশে এপ্রিল

নুরেমবুর্গের ঐতিহাসিক বিচারে যুদ্ধাপরাধী অফিসারেরা উঠেছিলেন কাঠগড়ায়, এঁদের অনেকেই ছিলেন মৃত্যুশিবিরের কুকর্মে জড়িত - অর্থাৎ গণহত্যাকারী। রেনে সেই বিচারের ফুটেজও রেখেছেন ছবিতে। না, কেউই দায় নেননি, ‘আই অ্যাম নট রেসপন্সিবল’, বারবার সাবটাইটলে এই বাক্যটাই আমরা ঝলসে উঠতে দেখি। অনপরাধী মুখে নাৎসি অফিসাররা জানান, তাঁরা যা কিছু করেছেন তা অনুতাপহীন ভাবেই করেছেন, কেননা উপরওলার নির্দেশ তামিল করাই ছিল তাঁদের কাজ। আবহে বাজতে থাকে পিয়ানোর একঘেয়ে টুংটাং, অদৃশ্য ভাষ্যকার জিজ্ঞেস করেন, ‘কে তাহলে দায়ী? কে!’ ... ‘হু ইজ রেস্পন্সিবল?’

আরও পড়ুন
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ছুরি ছোঁড়ার কাণ্ডারি তিনিই, প্রয়াত কিংবদন্তি জাগলার অভয় মিত্র

এখনও সেখানে পৈশাচিক বিদ্রূপের মতো খাড়া হয়ে আছে মরচে-ধরা কাঁটাতার, বাতিল লোহা লক্কড়, প্রত্ন-নিদর্শন; ‘যার মধ্যে থেকে অন্তহীন আর্তনাদ নিঃশব্দে উঠে আসছে’, ক্ষমাহীন স্বরে জানায় ছবিটি।

রেনে-র ছবিতে তাই রাত কখনো শেষ হয় না, কুয়াশাও সরে যায় না দৃষ্টির সামনে থেকে। হলোকস্ট নিয়ে এত দিনে অনেক ছবি হয়েছে, আরো হয়তো হবে। অনেকেই শুনে থাকবেন লাঞ্জম্যানের ন’ ঘণ্টা ব্যাপী তথ্যচিত্র ‘শোয়া’-র কথা, কিংবা লাজলো নেমেসের কাহিনিছবি ‘সন অব সল’-এর নাম। কেউই এড়াতে পারবেন না ১৯৫৬ সালের ছবিটিকে। চড়া সার্চলাইটের মতো নির্দয় ‘নাইট অ্যান্ড ফগ’কে আজও কুর্নিশ জানান মাইকেল হানেকে, যিনি নিজে মনে করেন, ‘প্রতি সেকেন্ডে ধার্য ২৪টি ফ্রেমেই চলচ্চিত্র তদন্ত করে সত্যি-র, যা সে করতে দায়বদ্ধ, এ ছাড়া তার অন্য কোনো কর্তব্য নেই।’

আরও পড়ুন
লকডাউনেও বন্ধুত্বের উদযাপন, সারেগামাপা-র ১৬ জন প্রতিযোগী গান তৈরি করলেন একসঙ্গে

‘নাইট অ্যান্ড ফগ’ সহ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি বানিয়ে হাত পাকিয়ে নিয়েছিলেন তরুণ অ্যালাঁ রেনে। এর পর জীবনের প্রথম ফিচার ফিল্মের জন্য তিনি পাড়ি দেন গ্রহের অন্য এক গোলার্ধে। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রদেশ ছিল তাঁর ছবির লোকেশন; বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ও সভ্যতার লজ্জা দগদগে হয়ে আছে যার প্রতিটি ইঞ্চিতে। ...সেই ছবির নাম ছিল ‘হিরোশিমা, মাই লাভ (১৯৫৯)।’