ক্ষুৎকাতর বাঙালির ‘ট্যাবু’ ও ‘বাসনা’ দুইই ধরা ছিল ‘মৌচাক’-এ

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মৌচাক’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। দমফাটা হাসির কমেডি হিসেবে আজও তুলনাতীত জনপ্রিয় ছবি। সত্তর দশকে তৈরি হলেও সমকালের ক্ষোভের চিহ্নগুলো ছবিতে নেই, বলা ভালো যত্ন ক’রে বাদ দেওয়া হয়েছে! ...স্বর্ণযুগের সচরাচর যেমনটা রীতি, ছবির আপন জগতটি থেকেছে বাস্তব-এর রংচটা বৃত্তের বাইরে, হয়ে উঠেছে প্রায় নন্দনকানন।

সুদর্শন নায়ক সীতেশ বা তার দেবোপম দাদা নীতিশ, ডাক্তার গুপ্ত কিংবা শ্রীযুক্ত তালুকদার, সকলেই জাগিয়ে রেখেছে স্নিগ্ধ হাসির আবেগ। কোনো ভাবেই ‘আর্ট সিনেমা করছি’ এ-হেন ভান করেননি পরিচালক, উদ্দেশ্য ছিল অতি স্বচ্ছ। বাঙালি দর্শকও খোলামনেই ছবিটি গ্রহণ করেছে। অযথা প্যাঁচ কষা অতএব নিষ্প্রয়োজন!

আসলে ‘প্যাঁচালো চিন্তা’ আমাদেরই যুগের দোষ। ‘মৌচাক’ শব্দটি আমাদের কেন জানি কৌতূহলী করে তুলল। - আপাতভাবে নিরীহ, ঠিকই। একটু খুঁড়লেই অবশ্য পাব প্রণয়-মধু, যৌন-ব্যবস্থা ও মৌমাছি-সমাজ এই তিনেরই ইঙ্গিত। আগ্রহ আরো বেড়ে যায়, যখন দেখি ‘মৌচাক’ আমাদের একটি বিশেষ অভ্যাসের ‘চিহ্ন’গুলো চমৎকার ভাবে বুনে দেয়। বাঙালির ট্যাবু ও বাসনা, এই নিয়ে একরকম প্রবন্ধের দায়িত্ব নিয়েছে ছবিটা!  

দাদা-বৌদির সুখের সংসার, সন্তানের অভাব মিটিয়েছে তরুণ দেওর সীতেশ। বাড়ির আরেকজন সদস্য ‘চাঁপা’ নামে এক বিচ্ছু কাজের মেয়ে। সত্তর মাইল দূরের জুট মিলে যেই চাকরি পায় সীতেশ, বৌদির মাথায় ভেঙে পড়ে বাজ। আদরের দেওরকে ছেড়ে দিতে হবে বিদেশ বিভূঁইয়ে! চিন্তায় পড়ে যান দাদাও। এমন সময় চাঁপা প্রস্তাব করছে, ‘আমি যাব ছোড়দার সাথে?’ সঙ্গে সঙ্গে ঝামরে ওঠেন বৌদি, ‘শুনছ এর কথা? সোমত্ত মেয়ে, বলে কিনা...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজের মেয়ে ও যুবক দেওর, এই পুরাতন ‘ট্যাবু’ নিয়ে শুরুতেই মুচকি হেসে নেয় ‘মৌচাক’।

পরতে পরতে খুলতে থাকে চেনা কেচ্ছাময় নমুনাগুলি। ধরা যাক, সুদর্শন ব্যাচেলর ডাক্তার গুপ্তের সঙ্গে এক বিধবা যুবতীর নিষিদ্ধ প্রণয়, যার কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় ঘাড়ে হাত ঘষেন তালুকদার (অনুপকুমার)। ডাক্তার গুপ্তের চেম্বারে ছোটো মেয়েকে দেখাতে এসেছেন প্রৌঢ় বিনয়বাবু (হরিধন মুখোপাধ্যায়)। ‘আপনার ছেলেমেয়ে ক’টি?’ জিজ্ঞেস করতে উত্তর আসে, ‘আজ্ঞে তা মন্দ নয়, মিলিয়ে জুলিয়ে সাতটি।’ একটু অপরাধী মুখ করেই কবুল করেন প্রৌঢ়, ‘আর একটি হব-হব করছে।’

দেওয়ালে সাঁটা জন্ম-নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞপ্তিটা আড় চোখে দেখান গুপ্ত। সেদিকে তাকিয়ে লজ্জায় পড়ে যান প্রৌঢ়। ‘তিনের বেশি আর নয়’, সত্তর দশকের এই সরকারি আদেশটি নিয়ে মুখরোচক কৌতুকের সু্যোগ কেই বা ছাড়ে। ফিউডাল বাঙালির এক গাদা সন্তান উৎপাদনের অভ্যেস যাবে কোথায়? কে আর মানছে নতুন ফরমান!

‘এবার ভ্যাসেকটমি করিয়ে ফেলুন,’ হাসিমুখেই বলেন ডাক্তার।  জনসংখ্যা কমাতে বন্ধ্যাত্বের প্রস্তাব শুনে অনেক পুরুষই আঁতকে উঠত সে-যুগে। বিনয়বাবুও শিউরে উঠে বলেন, ‘ক্যাস্ট্রেশন অব দ্য বলস! খোজা ক’রে দেবে?’ ‘আরেঃ না’, অভয় দিয়ে ডাক্তার গুপ্ত জানান, ‘এতে দাম্পত্যের মজাটা আছে, অবাঞ্ছিত পিতৃত্বের সাজাটা নেই!’ বেজার মুখে মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়েন অনিচ্ছুক বিনয়।

এই ডাক্তার গুপ্তই সীতেশকে বাঁচাতে চাইছেন কুমারী কন্যার বাপেদের থেকে। সেই মক্কেলের সংখ্যাও অনেক। অফিসের লেবার অফিসার, অধঃস্তন দুই কর্মচারী, স্বয়ং বস এবং সীতেশের বাড়িওলাও। কারও চার মেয়ে, কারও আবার ছয়। লেবার অফিসারের এখনও আট জনকে পার করা বাকি, সুতরাং দাবি তাঁর সবচেয়ে বেশি! এই নিয়ে প্রবল টাগ অব ওয়ারে সীতেশ নাজেহাল। অতি গুরুতর তার অপরাধ; একে সে ব্যাচেলর, সুদর্শন, শিক্ষিত চাকুরে, তায় আবার রাঢ়দেশীয় ব্রাহ্মণ!  

তাকে এ যাত্রায় উদ্ধার করে সহকর্মী তালুকদার। মেয়েরা বাপেরা চম্পট দেন ধমক ধামক শুনে। ‘বুঝলেন, এঁদের জন্য আমার দুঃখ হয়’, হাসি মুখেই সে জানায় বিধ্বস্ত সীতেশকে। অডিয়েন্সের দিকে চোখ তুলে এও বলে, ‘সবাই হাসে বটে, হাসছেও... কিন্তু কী জানেন, এ হল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ইটারনাল ট্র্যাজেডি!’ কমিক সুর থেকে বেরিয়ে ছবিটা বিষন্ন হয়ে যায় এক পলকের জন্য।

মনে পড়ে কি, জঁ লুক গোদারের ‘পিয়েরো লে ফু’ (১৯৬৫) ছবিতে অডিয়েন্সের উদ্দেশ্যে কথা বলেছিল বেলমন্দো-কারিনা জুটি? ঠিক এই ভাবেই, হ্যাঁ, থার্ড ওয়াল ভেঙে দিয়ে!                     

সমকাল থেকে এরকম উদ্ধৃতি ছবিতে অজস্র। গুলবাজ ব্যানার্জি মুড়ি মুড়কির মতো বিগ নেম ‘ড্রপ’ করেন, যেমন নেতাজী সুভাষচন্দ্র, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, গান্ধিজী এবং অবশ্যই ভুল উচ্চারণে ‘লেলিন’। ‘১৯২২-এ জওহরলাল যখন আমায় ওনার সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন’, শুনে তালুকদার বলেন, ‘জওহরলাল গাঙ্গুলি।’ প্রবল আপত্তি জানান গুলবাজ, ‘গাঙ্গুলি নয়, নেহেরু!’

নিজে থেকেই সীতেশের বাসার বন্দোবস্ত করেন এ হেন ভদ্রলোক, যার দুপাশেই নাকি ‘খাটা পায়খানা’। লেবার ম্যানেজার এই নিয়ে বিদ্রূপ ক’রলে তাঁর ঝটিতি জবাব, ‘আর আপনার বাড়ি তো মেথর পাড়ায়, যত শুয়োরের বাচ্চারা সেখানে চরে বেড়ায়!’ যুক্তফ্রন্ট শাসিত ১৯৭৪ সালের পশ্চিমবঙ্গের চমৎকার বিশ্বাসযোগ্য ছবি সংলাপে ধরা দিয়েছে।

পুংতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে ক্ষুরধার সব রগড়। ...চরিত্রগুলি সকলেই নিশ্চিত, ‘পুরুষের বিয়ে হওয়া যতটা সহজ, মেয়ের বিয়ে হওয়া তেমনই শক্ত!’ সীতেশ ‘মাতাল’ ও ‘লম্পট’, এই বলে পোস্টার মারলেও মেয়ের বাপেরা হাল ছাড়ার পাত্রই নন। ‘ভেবে দেখলাম, পুরুষমানুষের অমন দোষ একটু আধটু থাকে। সোনার আঙটি আবার বাঁকা!... ভাববেন না, আমার মেয়ে আপনার এই সব কিছু কন্ট্রোল ক’রে নেবে।’

বা ধরা যাক বাবু-কালচারের কথাই।  ডাক্তার গুপ্ত ‘ভিজিট কল’ রাখতে যান বেশ্যাপাড়ায়, যেখানে রোগিণীটি হলেন প্রৌঢ় ফিউডালের ‘রেন্টেড ওয়াইফ’। ‘তার মানে কী?’ ডাক্তার শুধোলে প্রৌঢ় বিনয়বাবু সগর্বে জানান, ‘কেন, আমার উপপত্নী!’ - ‘এই বয়েসেও! সাত ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে...’ বিস্ময় আটকাতে পারেন না ডাক্তার। ‘সাত ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে যদি গোঁফ রাখতে পারি, উপপত্নী কেন রাখতে পারব না মশাই!’- বাবুশ্রেণির অনন্য ক্যারিকেচার।

আবার ভদ্রসন্তান সীতেশকে যেই দেখেন বেশ্যাপাড়ার মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতে, অমনি আঁতকে ওঠেন ডাক্তার। শিক্ষিত বাঙালির দুটি ট্যাবু বেরিয়ে পড়ে থলে থেকে। বেশ্যা ও মদ, সীতেশের উদারমনস্ক দাদাও এই দুটি জিনিস মেনে নিতে পারছেন না। ‘নষ্ট’ চরিত্রের সেই চিরচেনা সব সিম্পটম! ভদ্রবাড়িতে ‘কাচের বোতল’ মানেই তাতে কিছু গোলমাল আছে, এই ধারণার বশে সীতেশের বৌদি রান্নাঘর থেকে উদ্ধার করেন ‘মদ’-এর বোতল। যদিও সেটি আসলে ফিনাইলের, ‘গন্ধ শুঁকেও বুঝতে পারো না?’ বিরক্ত হয়ে বলেন দাদা নীতিশ।         

বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে ড্রাইভারের প্রেম, এই ‘কমন ফেনোমেনা’টিও দাগানো আছে। ‘ট্যাক্সি চালায় পাঁচু, আর পাঁচুকে চালায় চাঁপু’, ভোলা যায় না এই ডায়লগ। ফাঁকা বাড়িতে যুগল ঘনিষ্ঠ হয় এবং পাঁচু নিজেকে হিন্দি ফিল্মের হিরো ভেবে গান ধরে (ইয়ে মোহব্বত...), নিয়ম মেনেই তক্ষুনি ঘরে ঢোকেন বৌদি। ফুলদানি হাতে বাড়ির গিন্নি তাড়া না করলে গোপন প্রেমই বা জমবে কী ক’রে? ...বাঙালি ঘরের কেচ্ছা যত রকম হতে পারে, তার প্রতিটি ধরনই ছবিটা হাসির দমক তুলে দেখিয়ে যায়!  

নায়িকার পিতা হিসেবে থাকতেই হয় এক অর্থোডক্স কড়া হেডমাস্টারকে। যেমনটা বলা হয়, বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা; তাঁর নিজের চতুর মেয়েই হাবুডুবু খায় সীতেশের প্রেমে। কোচিং ঘরে বালক ছাত্র ‘সিস্টার’ শব্দের মানে করে ‘শ্বাশুড়ি’। ‘মা বাবার পর ভাত খায়’, তার তর্জমা - ‘মাদার ইটস মাই ফাদার।’ ...উদ্যানে অপেক্ষারত তরুণীর সাথে বখাটে ছোঁড়ারা মশকরা করতে আসে, ‘কার অপেক্ষায়, নীপা দেবী?... চলো না, একটু নৌকা বিলাস করি!’ নীপার সপাটে চড় খেয়ে তোতলার প্রতিক্রিয়া, ‘ও-ও-ওকে মারলে!’ ...রাস্তাঘাটে যুবতীদের চলাফেরা তখনও এ রাজ্যে অসংকোচ নয়, ইভ টিজিং-ও দস্তুর মতো বহাল, বোঝাই যায়।

বিয়ে নিয়ে তালুকদারের উচ্ছ্বাসও বাঙালি-র বিবাহ-কাতরতার তুখোড় প্যারোডি। ‘কী’সে বেশি নেশা হয় বলুন তো, চরস, এল এস ডি না মদ’, উদভ্রান্ত সীতেশের এহেন উক্তি শুনে সে টেবিল চাপড়ে জানায়, ‘আমার ধারণা বিয়েতেই সবচেয়ে বেশি নেশা হয়! আপনি বিয়েটা ক’রেই দেখুন না!’ পাড়াগাঁয়ে যেমনটা হত, ‘ওঠ ছুঁড়ি, আজ তোর বিয়ে’, কলকাতা শহরেও এমনটা তখন বিরল নয় দেখা যাচ্ছে। ‘ছুঁড়ি’র বদলে ব্যাচেলর যুবক আসন্ন বিবাহ-হেতু কতটা পুলক পেতে পারে, তার নমুনা নিজেই জানাচ্ছে তালুকদার, ‘আমার বিয়ের খবর শুনে আমার তো মাথাই খারাপ হয়ে গেছিল!’    

পুরোনো বাঙালির যৌনকাতর জীবন নিজের সমস্ত মুদ্রাদোষ নিয়ে এভাবেই লুকিয়ে বেঁচে রয়েছে ‘মৌচাক’ ছবিতে।