বিজয়গড়ের বুকে অভিনব মেলা, ক্রেতা ও উৎপাদকদের মধ্যে সেতুবন্ধন করছে ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’

“বাজার বিষয়টা ভীষণভাবে কর্পোরেট ধারণা। বাজারের ধর্মই হল বৈচিত্রকে শেষ করে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তাতে প্রধানত ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন।”

বলছিলেন ফুড অ্যাক্টিভিস্ট এবং সমাজকর্মী অংশুমান দাস। প্রসঙ্গ, বিজয়গড়ের জ্যোতিষ রায় কলেজে আয়োজিত ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’ (Math Theke Rannaghor) মেলা। ‘মেলা’ কথাটি ব্যবহার করা হলেও, আমাদের প্রথাগত মেলার থেকে এই আয়োজন বেশ খানিকটা আলাদা। সেখানে যেমন বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে হাজির হয়েছেন উৎপাদকরা, তেমনই জমায়েত করেছেন পরিবেশকর্মী ও সমাজকর্মীরাও। ৫ ও ৬ আগস্ট আয়োজিত হওয়া এই মেলায় পণ্য বিক্রি, প্রদর্শনীর পাশাপাশেই চলছে জনসচেতনতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। ফলে বৃহত্তর দিক থেকে এই আয়োজনকে আন্দোলন বললেও ভুল হয় না এতটুকু।

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই, বিশেষত করোনা মহামারীর পর থেকে বদলে গেছে বাজারের ধারণা। সাধারণ মানুষ ঝুঁকছে অনলাইন মার্কেট প্ল্যাটফর্ম, অর্থাৎ ইকমার্সের দিকে। অংশুমানের কথায়, “বাজার হল উৎপাদক, ক্রেতা, বিক্রেতা এবং সাধারণ মানুষের একটা আদানপ্রদানের জায়গা। সেটা অর্থের আদান-প্রদানই হোক বা টেকনোলজির, কিংবা নিছক খবর আদানপ্রদান। কর্পোরেটাইজেশন আর মনোপলাইজেশনের ফলে এই সামাজিক কাঠামোটা ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে।” আর এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হচ্ছে কৃষক, ছোটো ও মাঝারি শিল্পী-সহ বিভিন্ন উৎপাদকরা।

এই সমস্যার ইতি টানতেই, বছর কয়েক আগে ক্রেতা এবং উৎপাদকদের মধ্যে সেতুবন্ধনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন সমাজকর্মী ও ফুড অ্যাক্টিভিস্টরা। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয় বিশেষ মেলা ‘ফারমার’স মার্কেট’ (Farmer's Market)। সরাসরি কৃষকরা তাঁদের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পেতেন এইধরনের মেলায়। ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’-এর ভিত্তি বলা চলে এই মেলাকেই। তবে ‘ফারমার’স মার্কেট’-এর থেকে তার চরিত্র খানিকটা ভিন্নতর। কেমন?

“সবসময় বাজারে এসে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না উৎপাদকদের। তবে কলকাতার বুকে বহু মিডলম্যান আছেন যাঁরা কৃষকদের ন্যায্য মূল্যটা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এইসব ছোটো এবং সৎ ব্যবসাদার— সৎ বলতে শুধু আর্থিক স্বচ্ছতার দিক থেকেই নয়, পরিবেশগত প্রভাবের দিক থেকেও যাঁরা সচেতন, তাঁদের নিয়ে একটি সমান্তরাল ও বিকল্প বাজার তৈরির প্রচেষ্টা করেছিলেন আমরা”, জানালেন অংশুমান। সেই প্ল্যাটফর্মই ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’। যেখানে দাঁড়াবার জায়গা পাচ্ছেন বাংলার বহু সচেতন উৎপাদক, ব্যবসায়ীরা। শুধু বেচা-কেনাই নয়, সাধারণ মানুষের দায়িত্বশীল ক্রেতা হওয়ার বিষয়টি নিয়েও ক্রমাগত আলোচনা ও সচেতনতার প্রচার করে চলেছে এই প্ল্যাটফর্ম।

গত দু’বছর মূলত খাদ্য নিয়েই আয়োজিত হয়েছিল ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’। তবে চলতি বছরে খাদ্য থেকে সরে গিয়ে এই মেলার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে জৈব বস্ত্রশিল্প। সেখানে হাতে বোনা তাঁত থেকে শুরু করে জায়গা পেয়েছে পরিবেশবান্ধব ফাইবার, হেম্প ফ্যাব্রিক ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী।

তবে মজার বিষয় হল, এই আয়োজনে কোনো কর্পোরেট বিনিয়োগ নেই, নেই কোনো রাজনীতির যোগও। কেবলমাত্র ছোটো ও মাঝারি উৎপাদক, ব্যবসায়ী এবং সমাজকর্মীদের সমন্বয় এবং যৌথ সংগঠনেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’। প্রত্যেক ক্রেতারাই সেখানে হাজির হচ্ছেন নিজ নিজ খরচে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে বিপন্ন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের নতুন করে লড়াই করার, প্রথাগত ‘বাজার’-এ ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করছে ‘মাঠ থেকে রান্নাঘর’। চেষ্টা করছে সচেতন, দায়িত্বশীল ও পরিবেশবান্ধব একটি বিপণন-কাঠামো তৈরির।

Powered by Froala Editor