জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হাতিয়ার ক্রিকেট, নেপথ্যে ‘মাসাই ক্রিকেট ওয়ারিয়র্স’

তপ্ত রৌদ্রে ক্রিকেট খেলা চলছে পুরোদমে। প্রথাগত সাদা জার্সি, প্যান্ট, ব্যুটজুতো পরেই ফিল্ডিং করছেন একদল খেলোয়াড়। প্রচণ্ড রোদ থেকে বাঁচতে কেউ কেউ মাথায় পরেছেন সাদা টুপি বা হেলমেট। তবে যে-কারোর নজর কাড়তে বাধ্য আরেকদলের পোশাক। জার্সি-প্যান্টের বালাই নেই কোনো। তাঁদের কোমরে ধুতির মতো করে জড়িয়ে রাখা একখণ্ড লাল কাপড়। খালি গা। গলায় রঙিন পুঁতির নেকলেস। আবার কারোর মাথায় পাখির পালক লাগানো কাপড়ের মুকুট। এই অস্বাভাবিক পোশাক পরেই দিব্যি ব্যাটিং করছেন তাঁরা। সাবলীল বলিং এবং ফিল্ডিং-এও।

মাসাই (Maasai)। আফ্রিকার ঐতিহ্য, ইতিহাস, প্রথা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে যে-সকল নৃগোষ্ঠীর নাম উঠে আসতে বাধ্য, তাদের মধ্যে অন্যতম এই প্রাচীন জনগোষ্ঠী। কেনিয়া ও তানজানিয়ার বিস্তীর্ণ অরণ্যে তাঁদের একাধিপত্য ছিল একসময়। ইউরোপীয় শাসকদের আগমন, দেশভাগ, অরণ্যনিধন ইত্যাদি নানা কারণে বর্তমানে তাঁদের ‘রাজ্যপাট’-এর পরিধি কমলেও, এতটুকু ম্লান হয়নি আফ্রিকার এই যোদ্ধা জনজাতির গৌরবকাহিনি, আশ্চর্য সব সাংস্কৃতিক প্রথা। 

অবশ্য সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে মাসাইরাও খানিক বদলেছেন নিজেদের। ছেড়েছেন সিংহ শিকার। পরিচিত হয়েছেন আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সঙ্গে। এমনকি বিগত এক দশকে মাসাইমারায় রীতিমতো জনপ্রিয় বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। শুধু বিনোদনই নয়, বর্তমানে বর্শা, বল্লম বা তীর-ধনুকের বদলে একদল মানুষ হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটকেই। স্থানীয়দের মুখে তাঁরা পরিচিত ‘মাসাই ক্রিকেট ওয়ারিয়র্স’ (Maasai Cricket Warriors) বা ‘মাসাই ক্রিকেট যোদ্ধা’ নামে। কিন্তু ব্যাপার কী? কাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই? কীসের সঙ্গে লড়তে হাতিয়ার করে নেওয়া ক্রিকেটকে? 

বছর ছয়েক আগের কথা। কেনিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের সর্বপ্রথম ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় ঘটান দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষক আকিয়া বাউয়ের। বাউয়ের কানিয়ার লাইকিপিয়া অঞ্চলে হাজির হয়েছিলেন বেবুন সম্পর্কিত একটি গবেষণার কারণে। তবে আধুনিক সভ্যতার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে গিয়েই হাঁপিয়ে ওঠেন বাউয়ের। একঘেয়েমি কাটাতেই স্থানীয় মাসাইদের মধ্যে ক্রিকেটের প্রচলন করেন তিনি। হয়ে ওঠেন তাঁদের কোচ। 

প্রাথমিকভাবে বাউয়ের বেছে নেন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রদের। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তাদের জন্য নিয়ে আসেন ব্যাট, বল ও অন্যান্য খেলার সরঞ্জাম। সেইসঙ্গে ক্রিকেটের ভিডিও দেখিয়ে তাদের আগ্রহী করে তোলেন এই ‘নতুন’ খেলাটির সঙ্গে। তবে ক্রিকেট শুধুমাত্র কৌতূহলই জাগায়নি মাসাইদের মধ্যে, অল্পদিনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। সেই সূত্র ধরে মাসাই সমাজে ক্রমশ বাড়তে থাকে ক্রিকেটারের সংখ্যা। ক্রিকেটের প্রতি মাসাইদের আগ্রহ দেখে ‘ক্রিকেট উইথআউট বাউন্ডারি’ নামের একটি অলাভজনক সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন বাউয়ের। এই সংস্থার সৌজন্যেই প্রত্যন্ত কেনিয়ায় শুরু হয় ছোটো ছোটো ঘরোয়া টুর্নামেন্ট। ছাত্রছাত্রীদের বাইরে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন প্রাপ্তবয়স্করাও। কেনিয়া তো বটেই, ধীরে ধীরে ক্রিকেট খেলতে লাইকিপিয়ায় হাজির হতে থাকেন তানজানিয়ার মাসাইযোদ্ধারাও। 

উপযুক্ত পরিকাঠামো, তহবিলের অভাব, পূর্ণ-আকারের প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের অভাব সত্ত্বেও বর্তমানে বলিষ্ঠ ক্রিকেট দল রয়েছে মাসাইদের। বলিষ্ঠ বলা এই কারণেই, কেন-না বিশ্বের যে-কোনো প্রথম সারির ক্রিকেটারদের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম তাঁরা। সবমিলিয়ে ২৪ জন প্রথম সারির খেলোয়াড় রয়েছেন মাসাইদের দলে। মূলত তাঁরা পোলি এবং এন্ডানা অঞ্চলের বাসিন্দা। ২০২১ সালে তহবিল সংগ্রহের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-২০ টুর্নামেন্ট খেলতে পাড়ি দিয়েছিল এই দল। সেটাই ছিল মাসাইদের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেবার একটি ম্যাচে জিততে পারেনি এই দল। তবে প্রোটিয়াদের প্রথম শ্রেণির স্থানীয় দলগুলিকে কড়া চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন মাসাইরা। গতবছর এই একই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল এই দল। ফলে নতুন করে বলার অপেক্ষা থাকে না, ক্রিকেটে ক্রমশ নিজেদের ডানা মেলে ধরছেন মাসাইরা। 

তবে বর্তমানে শুধুমাত্র বিনোদনই নয়, তার পাশাপাশি মাসাইদের কাছে ক্রিকেট হয়ে উঠেছে অন্যতম প্রচারের মাধ্যম। সামাজিক সমস্যা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনা তৈরি করতে ক্রিকেটকেই প্রচারের হাতিয়ার করে নিয়েছেন মাসাইরা। মহিলাদের যৌনাঙ্গচ্ছেদন, বাল্যবিবাহ, পশুশিকার থেকে শুরু করে অন্তর্গোষ্ঠী লড়াই, এইডসের সম্পর্কে সতর্কতা ও সচেতনতা তৈরির হাতিয়ার হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রিকেট। সাম্প্রতিক সময়ে মাসাইদের ক্রিকেট যোদ্ধাদের এই লড়াই নজর কেড়েছে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থারও। ধীরে ধীরে সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ আসছে মাসাইমারায়। সবমিলিয়ে বলতে গেলে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই যেন নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছেন মাসাই যোদ্ধারা…

Powered by Froala Editor