হাঙ্গরের কামড়ে হাত-পা হারিয়েও, সংরক্ষণের কাজে অনড় অস্ট্রেলিয়ার ‘শার্ক-ম্যান’

২০০৯ সাল। সে-সময় প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল খবরটা। অস্ট্রেলিয়া উপকূলে হাঙ্গরের আক্রমণে প্রাণ হারাতে বসেছেন এক অজি সৈনিক। একটি হাত ও একটি পা কেটে নিয়ে গেছে বুল শার্ক। সে-সময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল এই ঘটনা। কল্পনাপ্রবণরা অনেকেই হয়তো এই দৃশ্যপটকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন ‘জ’ কিংবা ‘মেগাশার্ক’ সিনেমার সঙ্গে। কিন্তু তারপর? না, আমরা আর খোঁজ রাখিনি আদৌ প্রাণে বেঁচেছিলেন কিনা সেই ব্যক্তি।

পল ডি গেলডার (Paul De Gelder)। হ্যাঁ, নৌসেনার অভ্যাসের সময় হাঙ্গরের (Shark) আক্রমণে হাত ও পা হারিয়েছিলেন তিনিই। দীর্ঘ ৬ মাস লড়াই-এর পর শেষ পর্যন্ত প্রাণ বেঁচেছিল তাঁর। তবে বদলে গিয়েছিল জীবন। সেনাবাহিনীতে ফিরলেও আধিকারিকের কাজ করতে হত তাঁকে। জীবন থেকে এক ঝটকায় সরে গিয়েছিল সমস্ত অ্যাডভেঞ্চার। আর সেই অ্যাডভেঞ্চার ফিরে পেতেই চাকরি ছাড়েন তিনি। তারপর বলতে গেলে একরকম হাঙ্গরদের সঙ্গেই সহবাস।

হ্যাঁ, অবাক লাগলেও সত্যি। এমন বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়েও হাঙ্গর সংরক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পল ডি গেলডার। শুরুটা হয়েছিল ২০১১ সালে। অস্ট্রেলিয়ার এক ব্রডকাস্টিং সংস্থা তাঁর কাছে দ্বারস্থ হয়েছিল একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য। ফিজি দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে তাঁকে ডিপ-সি ডাইভিং করতে হবে। সময় কাটাতে হবে হাঙ্গরদের সঙ্গে। হাঙ্গরের প্রতি চিরআতঙ্ক থাকলেও স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই ফিজি ছুটেছিলেন তিনি। না, এবার আর হতাশ হতে হয়নি। বরং, তাঁর কাছে খুলে গিয়েছিল এক নতুন দরজা। নিজে হাতে হাঙ্গরদের খাইয়েছিলেন তিনি। প্রথমবারের জন্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন হাঙ্গররা আদতে যেচে আক্রমণ করে না মানুষকে। 

আজ গেলডারের অভিমত সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০০৯ সালের সেই ঘটনাটিকে আক্রমণ বলে দাগাতে নারাজ তিনি। বরং, সেই ঘটনার কারণটাও যথেষ্ট স্পষ্ট তাঁর কাছে। সেনা অভ্যাসের জন্য সমুদ্র থেকে একটি বড়ো মাছের মৃতদেহ সরানো হয়েছিল সে-সময়। কাজটা করেছিলেন তিনিই। ফলে তাঁর পোশাকেও নানাভাবে লেগে ছিল মাছের গন্ধ এবং রক্ত। আর সেই কারণেই তাঁকে আক্রমণ করে বসে ১০ ফুট দীর্ঘ হাঙ্গরটি। তাঁকে আদতে মৃতদেহই মনে করেছিল সে। 

আরও পড়ুন
আইনেও মেলেনি সমাধান, কবে থামবে ভারতের হাঙ্গর শিকার?

গেলডারের মতে হিংস্রতার নিরিখে বাঘ, সিংহ কিংবা ভাল্লুকের মতো স্থলজ প্রাণীরা থাকে তালিকার শীর্ষেই। অরণ্যে বাঘ বা সিংহের সম্মুখীন হলে বেঁচে ফেরার আশা নেই বললেই চলে। কিন্তু হাঙ্গর সমুদ্রের অ্যাপেক্স প্রেডিটর হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে ডাইভারদের সঙ্গে। অন্তত যেচে আক্রমণ করে না তারা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন সিনেমাতে তাদের চরিত্রকে এমনভাবে দেখানো হয়, যে ছোটো থেকে ভুল ধারণা গড়ে ওঠে মানুষের মধ্যে। 

আরও পড়ুন
পুরুষ-সঙ্গ ছাড়াই সন্তানপ্রসব, হাঙরের কীর্তিতে তাজ্জব বিজ্ঞানীরা

এই ধারণা বদলাতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। হাঙ্গর সম্পর্কিত একাধিক তথ্যচিত্রের নেপথ্যে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন সেনানী। সেইসঙ্গে প্রায় সারাবছরই চালিয়ে যান সচেতনতা বিস্তারের নানান অনুষ্ঠান। হাঙ্গর সংরক্ষণেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অস্ট্রেলিয়া তো বটেই, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকোর নানান হাঙ্গর সংরক্ষণ প্রকল্পের সঙ্গেও জুড়ে রয়েছেন তিনি। ১৯৭০ সালের পর পাঁচ দশকে ৭১ শতাংশ কমেছে হাঙ্গরের সংখ্যা। যা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে বলেই দাবি তাঁর। হাঙ্গর-নিধন ও খাদ্য হিসাবে হাঙ্গরের ব্যবহার বন্ধ না হলে, আর কয়েক দশকের মধ্যেই বিলুপ্তির পথে হাঁটবে এই প্রজাতি। এমনটাই আশঙ্কা তাঁর। তাই অক্লান্তভাবেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ‘শার্ক-ম্যান’। এই লড়াই-এর সামিল করছেন বিশ্ববাসীকেও…

আরও পড়ুন
অন্ধকারেও ‘উজ্জ্বল’ হাঙর, বৃহত্তমের হদিশ নিউজিল্যান্ডে

Powered by Froala Editor