লিভারপুলের প্রথম এফএ কাপ জয়ের নায়ক তিনি, চলে গেলেন কিংবদন্তি ‘সেন্ট’ জন

ষাট দশকের শুরুর দিকের কথা। সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল লিভারপুল। স্বাক্ষরিত হয়েছিল তৎকালীন সময়ের রেকর্ড ৩৮ হাজার পাউন্ডের চুক্তি। মাদারওয়েল থেক অ্যানফিল্ডের মাঠে পা রেখেছিলেন স্কটিশ ফরোয়ার্ড আয়ান সেন্ট জন। যদিও প্রাথমিকভাবে লিভারপুল ক্লাবকর্তা স্কট বিল শ্যাঙ্কলির মত ছিল না এই ট্রান্সফারে। স্পষ্ট জানিয়েও দিয়েছিলেন ‘সেন্ট’-কে কেনবার মতো সামর্থ নেই ক্লাবের। তবে সেই একটা ট্রান্সফারই বদলে দিয়েছিল ক্লাবের ভাগ্য। সোনাকাঠির স্পর্শের মতোই পুনরুত্থান ঘটিয়েছিল অ্যানফিল্ডের।

গত ১ মার্চ ৮২ বছর বয়সে চলে গেলেন ফুটবলার, ব্রডকাস্টার এবং টেলিভিশন তারকা আয়ান সেন্ট জন। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন দুরারোগ্য প্রস্টেট ক্যানসারে। শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়লেন তিনি। শেষ হল একটি দীর্ঘ অধ্যায়। তাঁর পরিবারের তরফে গতকাল প্রকাশ্যে আনা হয় মৃত্যুসংবাদ। জানানো হয় স্কটল্যান্ডে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ফুটবলের ‘সন্ত’।

১৯৩৮ সালের ৭ জুন জন্ম আয়ানের। তখন মাত্র ছ’বছর বয়স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে। তার ওপরে আরও এক ধাক্কা আসে পরিবারে। মারা যান বাবা। আরও চরমে পৌঁছেছিল অর্থিক অভাব। ছয় ভাই-বোনের সংসারে ভাত জোগানোই দায় হয়ে ওঠে। বয়স আরেকটু বাড়তেই তাই স্কটল্যান্ডের স্টিল কারখানার ডেভিড কোলভিলে কাজ শুরু করেন তিনি। মজুরের কাজ। অক্লান্ত পরিশ্রম সারাদিন।

তবে কাজের ফাঁকেই আরও একটা নেশা ছিল আয়ানের। তা হল বক্সিং। সে-খেলার জন্য শরীরকেও তৈরি করে দিয়েছিল তাঁর কাজের প্রকৃতিই। তবে বাধা হয়ে দাঁড়ান তাঁর মা। বক্সিংইয়ে আঘাত পাওয়ার আশঙ্কাতেই ছেলেকে আর নামতে দেননি সেই খেলায়। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারেও আয়ান উল্লেখ করেছিলেন সেই স্বপ্নের কথা। ফুটবলার না হয়ে একজন সফল বক্সার হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর চিরদিনের।

আরও পড়ুন
প্রতি মিনিটে দুটি ফুটবল মাঠের আয়তনের অরণ্য লোপ, ভয়ংকর পরিস্থিতি ব্রাজিলে

স্টিল প্ল্যান্টে কাজ করার সময় থেকেই অবসর পেলে সহকর্মীদের সঙ্গে নেমে পড়তেন মাঠে। তারপর চলত ফুটবল যুদ্ধ। সেসময়ই স্কটিশ ফুটবলার ও কোচ ববি অ্যানসেলের নজরে আসেন তিনি। অ্যানসেলই তাঁকে জায়গা করে দেন মাদারওয়েলে। সেটা ছিল ১৯৫৬ সাল। শুরুর বছরে নিজের ক্লাবের হয়ে মাঠে নামতে পারেননি ঠিকই। পরের চার বছরে ১১৩টি ম্যাচে তিনি ৮০টি গোল উপহার দিয়েছিলেন অ্যানসেলকে। আর তারপরই সেই ঐতিহাসিক ক্লাব ট্রান্সফার।

বিতর্কে উপচে উঠেছিল ইউরোপের ফুটবল মহল। তবে ভক্তদের নিরাশ করেননি সেন্ট জন। অভিষেক ম্যাচেই হ্যাট্রিক। তাঁর গোলের ওপর ভর করেই লিভারপুল সিনিয়র কাপে এভার্টনকে বশ করেছিল ৪-৩ গোলে। পরবর্তী এক বছরে তাঁর ২২টি গোল লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল সেকেন্ড ডিভিশন কাপে। 

আরও পড়ুন
ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছেন অলিম্পিকেও, চলে গেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার নিখিল নন্দী

সেটা তো সবে শুরুর কথা। আরও বড় চমক অপেক্ষা করে ছিল লিভারপুলের জন্য। ১৯৬৪ সালে তাঁর দৌলতেই অ্যানফিল্ডে ঢুকল ফার্স্ট ডিভিশন ট্রফি। ১৭ বছরে সেই প্রথমবার। সেটাই যেন ছিল পুনরুত্থানের শুরু। পরের বছর এফএ কাপেও উড়ল লাল পতাকা। জয়ের নায়ক আয়ান সেন্ট জন। ১১৭ মিনিটে লিডসের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তাঁর কাঁধে ভর করেই ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে পৌঁছেছিল লিভারপুল। যদিও শেষ অবধি ২-১ গোলে হার মানতে হয় বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে।

তাঁর খেলায় অভিভূত হয়েছিলেন খোদ বিল শ্যাঙ্কলিও। ঐতিহাসিক সেই জয়ের পর একাধিক ক্লাবে খেলার সুযোগ এলেও অ্যানফিল্ড ছেড়ে যাননি সেন্ট জন। টানা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত লিভারপুলের হয়েই ঘাম ঝরিয়েছেন আয়ান। সব মিলিয়ে ৪২৫টি ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১১৮টি গোল। অ্যাসিস্ট ৫০টিরও বেশি। স্ট্রাইকার রজার হান্টের সঙ্গে তাঁর জুড়ি সেসময় ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে-কোনো দলের কাছে।

আরও পড়ুন
মিস করেননি একটিও ম্যাচ, সদ্যপ্রয়াত দম্পতিকে বিরল সম্মাননা তুর্কির ফুটবল ক্লাবের

স্কটল্যান্ডের হয়েও ২১টি ম্যাচ খেলেছেন সেন্ট জন। তেকাঠিতে বল গলিয়েছেন ৯ বার। যার মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা একটি স্মরণীয় গোলও। 

১৯৭১ সালে লিভারপুল ছাড়ার পর ইংল্যান্ডের সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাব কোভেন্ট্রি এবং আফ্রিকার ক্লাব কেপ টাউন সিটিতে খেলেছেন সেন্ট জন। তারপর ১৯৭৩ সালে অবসর ফুটবল থেকে। তবে ছিঁড়ল না সম্পর্কের সুতো। ওই একই বছরে শুরুর ক্লাব মাদারওয়েলেই ফিরলেন কোচ হয়ে। তারপর পোর্টসমাউথ-এও করেছেন ‘শিক্ষকতা’।

পরবর্তী সময়ে ব্রডকাস্টিং এবং ধারাভাষ্যকারের কাজও করেছেন তিনি। ব্রিটিশ ফুটবল তারকা জিমি গ্রিভসের সঙ্গে জুটি বেঁধে করেছেন ‘সেন্ট অ্যান্ড গ্রিভস’ টেলিভিশন শো। যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ব্রিটেনে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নিয়মিত আয়োজিত হত সেই অনুষ্ঠান।

কিংবদন্তি স্ট্রাইকারের চলে যাওয়ায় শোকের ছায়া ‘লাল’ শিবিরে। অ্যানফিল্ডের উত্থানের পিছনে অন্যতম কারিগর তিনি। ষাটের দশকের সেই বুনিয়াদ না গড়ে দিল হয়তো আজকের লিভারপুলকে চিনতে পারত না ফুটবল বিশ্ব। চলে গেলেন সেই ইতিহাসেরই জীবন্ত সাক্ষী…

Powered by Froala Editor