ফুটবলের গ্যাংস্টার ও এক অন্ধকার শহরের কিসসা

লাতিন আমেরিকায় একটা শব্দ প্রচলিত। ‘চোলো’। অর্থাৎ গুন্ডা কিংবা গ্যাংস্টার। এই ‘গ্যাংস্টার’ ব্যাপারটা ঠিক কেমন? প্রতিষ্ঠানবিরোধী? বটেই। আবার তারা পুঁজিবাদেরও দাস। ‘গ্যাংস্টার’রা ফ্যাতারু? অবশ্যই। তারা আবার কখনো কখনো বিপ্লবীদের চোখে শ্রেণীশত্রু। 

প্রায়-আগ্রাসী উয়েফার প্রাণপুরুষ কীভাবে জড়িয়ে ধরতে পারেন ফিদেল কাস্ত্রোকে। দামি হাভানা চুরুট টানতে টানতে, কীভাবে কাঁধে চে'র ছবি দেখান? গ্যালারিতে চূড়ান্ত অভদ্র আচরণ করেন, সতীর্থদের সম্পর্কে দুমদাম মন্তব্য ছোঁড়েন, হাত দিয়ে বল জালে ঢুকিয়ে বলেন, ‘বেশ করেছি। ওটা ভগবানের হাত ছিল।’ পরমুহূর্তেই পিটার শিল্টনকে ছবি বানিয়ে গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি।

১৯৮৪ সালে মারাদোনা বার্সেলোনা থেকে এলেন নাপোলিতে। রেকর্ড পাঁচ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে।  সান-পাওলো বিমানবন্দরে কাতার দিয়ে দর্শক। মারাদোনা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বার্সেলোনা আমায় ঠিক শান্তি দিতে পারেনি। তাই চলে এলাম।’ কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল, ইতালিয়ান মাফিয়ার সঙ্গেও ওঠাবসা রয়েছে তাঁর। সাংবাদিক বৈঠকে সেই প্রশ্ন একজন তুলেছিলেন। তাঁকে পত্রপাঠ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বার করে দেওয়া হল। নাপোলি তখন টিমটিমে লণ্ঠন। দক্ষিণ ইতালির আস্তাকুঁড়। নেপলস শহরকে বলা হত ‘ইতালির নর্দমা’। শহরজুড়ে গুন্ডারাজ। অভাব। খুনখারাপি। সেখানেই জাঁকিয়ে বসলেন ফুটবলের গ্যাংস্টার। ১৯৮৪ সালে নাপোলি রেলিগেশনের মুখে। ঝুলিতে একটিও সিরি-আ খেতাব নেই। বলা হয়, মারাদোনাকে আনার জন্য যে রেকর্ড ফি, তার মধ্যে কালো টাকার অঙ্ক খানিক বেশি। ফুটবল ঘিরেও চলছে জুয়ার চক্র। কোকেনের সাদা গুঁড়ো ফিরি হচ্ছে হাত থেকে হাতে। হয়তো এই অন্ধকার শহরের একজন মসীহা দরকার ছিল…

১৯৮৭ সালে নাপোলির ঐতিহাসিক লিগ জয়। তার একবছর আগেই বিশ্বকাপে মারাদোনা জাত চিনিয়েছেন নিজের। মাঠের একচ্ছত্র গ্যাংস্টার। রাগী, ভোঁতা, আবেগপ্রবণ। অথচ ফুটবল যে এগারোজনের খেলা, এই সত্যকে বারংবার ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছেন। অনেকে বলেন, বল পায়ে পড়লেই লোকটার গতিবেগ বেড়ে যায়। ড্রিবলিং-এ ম্যাজিক দেখান। ঠিক আর্জেন্টিনার মতোই একা হাতে নাপোলিকে খেতাব এনে দিলেন তিনি। গোল করলেন দশটা, করালেন প্রচুর। ৩০টি ম্যাচের মধ্যে ২১টি জিতে চ্যাম্পিয়ন হল ক্লাব। মন্দির গড়ে উঠল তাঁর নামে। হ্যাঁ, মন্দির। সেখানে বিগ্রহ, ফুটবলের ঈশ্বর। অন্ধকারে ডুবে থাকা একটা শহরের মসিহা।

কিন্তু দিয়েগো কি ‘শান্তি’ পেয়েছিলেন?

‘আমি চাইলাম সাতমহলা বাড়ি। পেলাম একটা ফ্ল্যাট। আমি চাইলাম ফেরারি গাড়ি। পেলাম একটা ফিয়াট।’ 

চূড়ান্ত দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়া আর্জেন্টিনীয় কিশোরের মধ্যে অর্থলিপ্সা থাকবেই। তবে শোনা যায় ইতালির সবচেয়ে বড়ো মাফিয়া কারমাইন জুলিয়ানো মারাদোনাকে ঢেকে দিয়েছিলেন উপঢৌকনে। কোকেন এবং অন্যান্য ব্যাভিচারী খেলায়, জুলিয়ানো ছিলেন দিয়েগোর বিশ্বস্ত কমরেড। কিন্তু একটু বেচাল দেখলেই আঘাত হানত মাফিয়া। ১৯৮৮ লিগের উপর মাফিয়ারা বাজি ধরেছিল। লাভ-ক্ষতির হিসেব কষে জুলিয়ানো দেখেন, তাঁরা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং মারাদোনাকে থামাতে হবে। ক্লাবের প্লেয়ারদের কাছে হুমকি গেল। মারাদোনার গাড়ি ভাঙচুর হল। সতীর্থ স্যালাভেতোরের ঘরে ডাকাত পড়ল দু'বার। বার্তাটি বুঝতে অসুবিধা হল না কারো।

১৯৮৯ সালে আবার লিগ জিতল ন্যাপোলি। ততদিনে দিয়েগোর কেরিয়ার জর্জরিত করে দিয়েছে নেশা ও বিতর্ক। মাঠের বাইরে তাঁর নৈশযাপন হয়ে উঠেছে মুখরোচক আলোচনা। কখনো কোকেন, কখনো নিষিদ্ধ বলবর্ধক ড্রাগ। তাঁর মধ্যেই জাদুকর করেছেন প্রায় ১১৫টি গোল। ১৯৮৯-তেই ট্রান্সফারের কথা চলছিল তাঁর। ফরাসি ক্লাব মার্সেইতে যাওয়ার কথা চলছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে রক্তে ধরা পড়ল কোকেন। মারাদোনার উপর নেমে এল ১৫ মাসের ব্যান। দিয়েগোর সেই অমোঘ উক্তি নাড়িয়ে দেয় নেপলসকে। 

‘আমি ফুটবলার। সাধুসন্ত নই…’

তাঁর ক্লাব ছাড়ার কানাঘুষো ছড়িয়ে পড়ল। রাতারাতি মারাদোনা হয়ে পড়লেন ভিলেন। ভাঙচুর শুরু রাস্তায়। প্রায় দাঙ্গা পরিস্থিতি। একদা রাজপুত্রের পতন। এর মধ্যেই নিঃশব্দে শহর ছেড়ে চলে গেলেন দিয়েগো। ওজন বেড়েছে তাঁর। হারিয়েছে গতি। ১৯৯০-র বিশ্বকাপে তাঁকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে জনতা। বিশ্বের চোখে মারাদোনা ট্র্যাজিক নায়ক তখনও। কিন্তু নাপোলির হাড়হাভাতে জনগণ, যাঁরা প্রত্যেক ম্যাচেই ঢেলে দিতেন নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ, গ্যালারিতে যাঁরা পাগলের মত চিৎকার করতেন, মারাদোনার ইশারায় যাঁরা নিজেদের আর্জেন্টিনীয় ভাবতেন তাঁরা খেপে উঠেছেন। শহরে তাঁর নামও উচ্চারিত হত না বহুদিন। সেই মানুষগুলোর চোখে তিনি বিশ্বাসঘাতক।

ধীরে ধীরে আবার প্রলেপ পড়েছিল ক্ষতে। জনগণ আবার আপন করে নিয়েছিল তাদের প্রিয় ‘চোলো'কে।

শোনা যায়, ১৯৮৯ লিগ জয়ের পর মারাদোনার সঙ্গে ক্লাব প্রেসিডেন্টের একটি কথোপকথন ধরা পড়েছিল রেকর্ডারে। যেখানে ১৯৮৮-র লিগ প্রসঙ্গে মারাদোনা বলেছিলেন, ‘সবসময় আমরা জিতলেই তো আর চলবে না। বাকিদেরও একটু জিততে দেওয়া উচিৎ। নয়তো ফুটবলের মজাটা আর কোথায় রইল!’

‘গ্যাংস্টার’-এর আসল অর্থ হয়তো এটাই…

সূত্র: 

1.The sainthood and fall from grace of Napoli’s Argentine deity : Shamik Chakrabarty, Indian Express

Powered by Froala Editor