‘সত্যজিতের সামনে খারাপ কথা বলতে পারব না’, প্রস্তাব শুনে বেঁকে বসলেন কমল মিত্র

আসানসোলের ব্যারেট ক্লাবে বসেছে নাটকের আসর। মান্যগণ্য ব্যক্তিরা হাজির হয়েছেন ক্লাবে। উপস্থিত হয়েছে ছোট্ট একটি নাট্যদল; তারাই মঞ্চস্থ করবে ‘আলমগীর’। নির্দিষ্ট সময় পর মঞ্চে হাজির হলেন সবাই। এবং প্রত্যেকের চোখ আটকে যাচ্ছে জয়সিংহকে দেখে। কি অসাধারণ অভিনয়! অসাধারণ গলা! নাটক শেষে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন তখনকার আসানসোলের এসডিও ম্যাক ইনার্নে সাহেব। জানলেন, জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করা ছেলেটি সামান্য এক সরকারি কালেক্টর। বর্ধমানের মিত্রবাড়ির ছেলে, নাম কমল মিত্র। কাজ তো কেবল পেটের জন্য, আসল নেশা অভিনয়। মুগ্ধ হলেন এসডিও সাহেব। সেইসঙ্গে দিলেন অমোঘ পরামর্শ— কলকাতায় চলে যাও। তোমার ভেতরের প্রতিভাকে নষ্ট করো না…

যেমন চেহারা, তেমন দরাজ গলা। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয়। কমল মিত্র বললে বাঙালি দর্শকদের চোখে এমন ছবিই উঠে আসবে। নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি সেভাবে, বেশিরভাগ কাজই করেছেন পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। তবে যে ভূমিকাই হোক না কেন, কমলবাবুর উপস্থিতি গোটা সিনেমাকেই একটা আলাদা জায়গা দিত। অনেকেরই মনে পড়বে ‘দেয়া নেয়া’য় তাঁর অভিনীত চরিত্রটির কথা। ব্যাকব্রাশ করা চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা আর স্যুট-পরিহিত এক ধনী ব্যবসায়ী। ছেলের প্রতিভাকে চিনতে না চাওয়া এক আত্মাভিমানী, দজ্জাল বাবার চরিত্রে কমল মিত্রের অভিনয় কি আজও ভুলতে পেরেছে কেউ! 

অভিনয়ের নেশা থাকলেও, এই পৃথিবীতে এসে পড়া একেবারে হঠাৎ করেই। তখন তাঁর বাবা, প্রখ্যাত উকিল নরেশচন্দ্র মিত্র পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন। বাধ্য হয়ে কালেক্টরিতে কেরানির চাকরিতে ঢোকেন কমলবাবু। সরকারি হলেও, সে চাকরি স্থায়ী হয়নি কোনদিনও। শুরুর দিকে চেয়ার টেবিল না থাকায় অফিসের বারান্দায় মাদুর পেতে কাজ করেছেন। এতসবের মাঝেও ছিল অভিনয়। জীবনে এলেন দুজন মানুষ— শিশিরকুমার ভাদুড়ি এবং দেবকীকুমার বসু। কমল মিত্র তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চাকরি ছেড়ে অভিনয়ই করবেন তিনি। বারণ করলেন দেবকীকুমার। এখনই এমন সিদ্ধান্ত নিলে বড়োই মুশকিল… 

এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র তো কমল মিত্র ছিলেন না। অভিনয় করতে গেলে কেবল সিনেমা নয়, থিয়েটারও করতে হবে। নিজের সঙ্গেই চলছে লড়াই। তখনও বর্ধমানে আছেন তিনি। সময় সুযোগ পেলেই চলে যেতেন দামোদরের তীরে। এক পাড়ে দাঁড়িয়ে শুরু হত সংলাপ বলা; আস্তে আস্তে নয়, রীতিমতো চিৎকার করে। অভিব্যক্তি এতটুকুও কম হলে চলবে না, আবার গলার আওয়াজও তৈরি করতে হবে। মঞ্চে উঠলে যেন রোয়ের শেষ মানুষটিও তাঁর গলা শুনতে পায়। যতদিন না সেই আওয়াজ দামোদরের ওপার থেকে একইভাবে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসত, ততদিন চলত এই কাজ। 

১৯৪৩ সাল। ‘নীলাঙ্গুরীয়’ ছবিতে প্রথমবার অভিনয়ের সুযোগ পেলেন কমল মিত্র। মাত্র একলাইন ডায়লগ, আর কিচ্ছু নয়। এর জন্য পারিশ্রমিকও পেলেন না। কিন্তু হাজার হোক, প্রথমবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো বলে কথা! তারপরই দেবকী বসু পরিচালিত হিন্দি সিনেমা ‘রামানুজ’-এ করলেন অভিনয়। এখানেও বেশি কাজ ছিল না; কিন্তু এল উপার্জন। ধীরে ধীরে জীবনের ছবিটাও বদলে যেতে শুরু করল। দেবকীবাবুরই ছবিতে অভিনয় করতে করতে আলাপ হল বিপিন গুপ্তের সঙ্গে। কমলবাবুর অভিনয় দেখে তাঁকে নিয়ে গেলেন স্টার থিয়েটারে। তখন সেখানে চলছে ‘টিপু সুলতান’। আপাদমস্তক দেখে তাঁকে সেই নাটকে নিতে রাজি হলেন নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত। এবার চাকরিটা ছাড়লেন কমল মিত্র। অভিনয়ই হল জীবনতরীর পাল… 

এই ‘টিপু সুলতান’ নাটকই জন্ম দিল অভিনেতা কমল মিত্রকে। প্রথমে ক্যাপ্টেন ব্রেথওয়েট, তারপর স্বয়ং টিপু— কমলবাবু তখন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছেন। মাথায় আছে দেবকী বসুর সেই অমোঘ উপদেশ- ‘আপনি কখনও নায়ক করবেন না। মানাবে না।’ চরিত্র অভিনয়ই হল কমল মিত্রের বেঁচে থাকার পথ। এবং আক্ষরিক অর্থেই সে জন্য তাঁকে আজীবন মনে রাখবে বাংলা সিনেমার জগত। শুধুই কি সিনেমা? একইভাবে দাপিয়ে বেরিয়েছেন নাটকে, যাত্রায়। তিনি যে সম্রাট! আর সেরকমই স্পষ্টবাদী, সত্যনিষ্ঠ। সোজা কথা সোজাভাবে বলতেই পছন্দ করেন। সামনে কে আছেন সেই দিকে লক্ষ থাকে না। 

আরও পড়ুন
প্রমথেশ বড়ুয়াই প্রকৃত ‘দেবদাস’, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উত্তমকুমার

তাঁর এই ‘দজ্জাল’ রূপটি নিয়ে দুটো গল্পের অবতারণা করা যাক। সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’ সিনেমার জন্য প্রস্তুতি সারছেন। ঠিক করলেন, এই ছবিতে কমল মিত্রকে নেবেন। সেইমতো লোকও হাজির হয়েছে তাঁর ঘরে। সত্যজিতের সিনেমা শুনেই তড়াক করে উঠলেন কমলবাবু। তিনি ওঁর ছবিতে কাজ করবেন! সেটা সম্ভব নয়। তাঁর মুখ খারাপ, যাকে তাকে যা খুশি বলে দেন। ওঁকেও যদি কিছু বলে বসেন! শেষে হাল ধরলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। কমল মিত্র না হলে ‘পরশপাথর’ও হবে না। শেষপর্যন্ত রাজি হলেন কমলবাবু… 

এ তো গেল সিনেমার কথা। মঞ্চেও তিনি ছিলেন একইরকম। তখন স্টারে অভিনয় করছেন তিনি। হঠাৎই তাঁর কাছে হাজির হলেন তিনজন মেয়ে। তাঁরাও নাটকে অভিনয় করছেন। কয়েকদিন ধরেই একজন ব্যক্তি বিরক্ত করে যাচ্ছেন তাঁদের। থিয়েটারে পার্ট দেওয়ার নাম করে আলাপ জমাবার চেষ্টা করছেন, গোপনে দীঘা নিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। আচ্ছা, এই ব্যাপার! এবার আসরে নামলেন স্বয়ং কমল মিত্র। সটান ওই ভদ্রলোকের সামনে হাজির হলেন। কী ব্যাপার? এভাবে ওঁদের হেনস্থা করা কেন? যতটা ভদ্রভাবে লেখা হল, ততটা নরমভাবে ঘটনাটি ঘটেনি। ভদ্রলোকের রীতিমতো ঘাম বের করে ছাড়লেন কমল মিত্র। সেইসঙ্গে ছুটল গালাগালির ফোয়ারা। এত কেন খিস্তিখারাপি করেন? উত্তরে একচোট হেসে কমলবাবু বলেন, ‘নিজের স্বাস্থ্যটা ভালো রাখার জন্য… ভেতরের ক্লেদ, আবর্জনা বের করার জন্য…’

এমনই ছিলেন কমল মিত্র। সব জায়গায় ছিলেন রাজা। নিজের শর্তে বেঁচেছেন, নিজের ইচ্ছায় অভিনয় এসেছেন; আবার হঠাৎ করে ছেড়েও দিলেন। সারাজীবনে প্রচুর নাটক, সিনেমা করেছেন। পর্দায় যতই দজ্জাল বাবা হন না কেন, বাস্তব জীবনে তিনি যে কতটা স্নেহপ্রবণ ছিলেন সেটা সেই সময়ের অনেকেই স্বীকার করেছেন। চেহারা, গলার আওয়াজের পাশাপাশি মনটাও ছিল সেরকম— দরাজ, বিশাল, ব্যক্তিত্বপূর্ণ… 

আরও পড়ুন
‘সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, বলেছিলেন উত্তমকুমার

তথ্যসূত্র-
১) ‘সাতরং প্রথম খণ্ড’/ রবি বসু
২) ‘বাঙালি পরিবারের এক আইকনিক কর্তা’, সুদেষ্ণা বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা 

Powered by Froala Editor

More From Author See More