সন্দীপ দত্তের মরদেহ নিয়ে শোকমিছিল, সাক্ষী রইল তিলোত্তমা

/১১

সন্দীপ দত্ত। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের নিত্যদিনের যোগ, তাঁরা সকলেই নামটির সঙ্গে পরিচিত। বিশেষত লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদের কাছে তিনি এক মহীরূহ। যেভাবে একটি বৃক্ষকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে আস্ত একটি বাস্তুতন্ত্র, তেমনই বাংলার অজস্র লিটল ম্যাগাজিনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। আজীবন লড়াই করেছেন ছোটো পত্রিকার অধিকারের জন্য।

/১১

গত পরশু ৭২ বছর বয়সে প্রয়াত হন ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা। আজ দুপুরে তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় কলেজ স্কোয়ারে। সেখানেই তাঁকে শেষ বিদায় জানালেন বাংলার লিটল ম্যাগাজিনকর্মী এবং সাহিত্যিকরা। শোকস্তব্ধ কলেজ স্কোয়ার শুনল সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীত।

/১১

হাজির ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সম্পাদক প্রসূন ভৌমিক, মৃদুল দাশগুপ্ত ও ‘কলকাতা ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র’-এর বর্তমান সম্পাদক রণদীপ দাশগুপ্ত-সহ আরও অনেকে। সন্দীপ দত্তের মরদেহে মাল্যদান করে শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁরা। ছিলেন সন্দীপ দত্তের পরিবারের সদস্য এবং সাহিত্যপ্রেমী মানুষজনরাও।

/১১

এদিন দুপুরে কলেজ স্কোয়ার থেকে প্রথমে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। অবসরগ্রহণের আগে পর্যন্ত এই স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন সন্দীপ দত্ত। শ্রদ্ধা জানান স্কুলের সহশিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। সেখান থেকে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নিমতলা শ্মশানে। পদযাত্রা করেই এই গোটা পথ অতিক্রম করেন অগুনতি মানুষ।

/১১

“সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস— বিবিধ গণআন্দোলন যেগুলো হয়েছিল। প্রতিটা মুভমেন্টের সঙ্গেই সন্দীপ অংশ নিত। লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, লেখক, সম্পাদক, কবি, শিল্পী— এঁদের সকলকে ও একজোট করতে পেরেছিল।” বলছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। জানালেন, “সন্দীপের চলে যাওয়া, আমাদের সময়ের যুগাবসানের সূচনা।”

/১১

আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন ‘বিজল্প’-এর সম্পাদক প্রসূন ভৌমিকও। “মনে আছে, সন্দীপদা আমাকে ডেকেছিলেন যখন বিজল্প শুরু করেছি। লাইব্রেরির ২৫ বছর পূর্তির একটি উৎসব হয়েছিল। উনি বলেছিলেন সেই উপলক্ষে একটি মিছিল করতে। সেই আয়োজনের মধ্যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছিলাম। আজ খারাপ লাগছে, সন্দীপদার শেষ মিছিলে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের। এটা একটা বড়ো দুঃখের জায়গায়।”

/১১

“৭৮ সাল থেকে সন্দীপদার সঙ্গে পরিচয়। সুতরাং তাড়না যেমন ব্যক্তিগতভাবে ছিল, তেমন আনুষ্ঠানিকভাবেও ছিল। কেন-না আমি একটি লিটল ম্যাগের সঙ্গে যুক্ত। যেটা হয়ে ওঠেনি, সেটা হল, লাইব্রেরির একটি ডকুমেন্টারি। সন্দীপদা থাকাকালীন এই কাজটা আমরা করে উঠতে পারিনি”, জানালেন চিরঞ্জীব শুর। বর্তমানে তিনি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির অন্যতম সদস্য এবং সহ-সম্পাদক।

/১১

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ থেকে শুরু করে ‘কৌরব’, ‘শতভিষা’, ‘পরিচয়’। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রে হাজির হলেই দেখা মিলবে এমনই আশ্চর্য প্রাচীন সব পত্রিকার নিদর্শন। সঙ্গে সেখানে জায়গা পেয়েছে সমসাময়িক ছোটো পত্রিকাদের সাম্প্রতিকতম সংখ্যারাও। সবমিলিয়ে বলতে গেলে যে-কোনো লিটল ম্যাগাজিন করিয়ের কাছেই এ-যেন এক স্বপ্নরাজ্য। সাহিত্যচর্চার ‘মন্দির’। প্রশ্ন থেকে যায়, সন্দীপবাবুর অবর্তমানে কে সামলাবেন এই বিপুল রত্নসম্ভারের রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্ব?

/১১

“আমাদের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি যেটা, সেটা হল, এই লাইব্রেরির কোথায় কী আছে, সেটা কেবল ওঁর মাথাতেই ছিল। কাজেই এই লাইব্রেরিকে নতুন করে সচল করতে বেগ পেতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই আমরা এটাকে হারিয়ে যেতে দেব না”, উত্তর দিলেন প্রসূন ভৌমিক।

১০/১১

‘দামোদর’ পত্রিকার সম্পাদক উজ্জ্বল ঘোষ জানালেন, “লিটল ম্যাগাজিন মানেই তো সন্দীপদা। এমন কোনো সম্পাদক নেই, যিনি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ওঁর সাহায্য পাননি। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে, ওঁর লাইব্রেরিটা সংরক্ষণ করা। ওঁর কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের মতো তরুণদেরই লাইব্রেরিটিকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই উদ্যোগটা নিতে হবে।”

১১/১১

সবমিলিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্তকে শেষ বিদায় জানানোর দিন যেন তাঁর ঐতিহ্যময় লাইব্রেরিকেই বাঁচিয়ে রাখার প্রতিজ্ঞা নিলেন শহরের সম্পাদক, লেখকরা। এ যেন গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো। বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর গড়ে তোলা এই লাইব্রেরি ঐতিহ্য বজায় থাকবে আগামীতেও, আশার এই আলোকবর্তিকাটুকুই জ্বলে থাকল শোকস্তব্ধ কলকাতায় বুকে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More