ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাবি ফরাসি ঐতিহাসিক ও যুদ্ধবিশ্লেষকের

তিলে তিলে গড়ে তোলা সাম্রাজ্য কিংবা মিত্রপক্ষের ওপর থেকে ক্রমশ প্রভাব কমতে থাকলে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। জিও-পলেটিক্স বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ম এমনটাই। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিজের প্রভাব বহাল রাখার জন্য যদি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে দুই মহাশক্তি? হ্যাঁ, অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধে পরিণতি পাবে এই পরিস্থিতি। তবে শুধু দুই মহাশক্তিই নয়, সঙ্গে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে আরও অনেক ছোটো-মাঝারি রাষ্ট্ররাও। আর এই সম্মিলিত বিশৃঙ্খলতাই কি বিশ্বযুদ্ধ নয়? 

সম্প্রতি এমনটাই দাবি করেছেন ফরাসি বুদ্ধিজীবী, ঐতিহাসিক, নৃবিজ্ঞানী এবং যুদ্ধবিশ্লেষক ইমানুয়েল টড (Emmanuel Todd)। টডের কথা অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ (Third World War)। যার একদিকে রয়েছে পশ্চিমী দুনিয়া অন্যদিকে রাশিয়া এবং রুশ-সমর্থিত অন্যান্য নানান রাষ্ট্র। 

কিন্তু সত্যিই কি এমনটা? বিশ্বযুদ্ধ বললেই তো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোটা দুনিয়াজুড়ে ধ্বংসের ছবি, দরিদ্র মানুষদের হাহাকার, পোকা-মাকড়ের মতো লাখ লাখ সেনার মৃত্যু এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়। সেইসঙ্গে অবশ্যই একাধিক বৃহত্তর শক্তির মধ্যে পারস্পরিক জোট। বর্তমানে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে ঠিকই, কিন্তু সেই যুদ্ধের ধ্বংসলীলা তো কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ উত্তর-পূর্ব ইউরোপেই। পাশাপাশি কেবলমাত্র দুটি দেশের মধ্যেই চলছে এই লড়াই। তা সত্ত্বেও, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে— ইমানুয়েলের এমন আশ্চর্য দাবির কারণ কী? 

আসলে তিনি তুলে আনছেন অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি যেমন ভার্সাই সন্ধি ভেঙেছিল, ঠিক সেভাবেই ভেঙে যাচ্ছে রুশ-যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক সমঝোতা। যার মধ্যে সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল নিউক্লিয়ার আর্মস ট্রিটি। চলতি বছরেই যে সন্ধি ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যদিকে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করার জন্যও ক্রমশ চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতার এই দোলাচলই ইঙ্গিত দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

টডের মতে, রুশ-ইউক্রেনের যুদ্ধ বর্তমানে পরিণত হয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে। ন্যাটোকে প্রতিহত করতে অধিকৃত ইউক্রেনের অংশগুলোকে ‘বাফার জোন’ হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশিয়া। অন্যদিকে ইউক্রেনকে ন্যাটোর অংশ করে রাশিয়ার ঠিক ঘাড়ের পাশে নিঃশ্বাস ফেলার পরিকল্পনা পশ্চিমী দুনিয়ার। সক্রিয়ভাবে পশ্চিমী দুনিয়া এই যুদ্ধে অংশ না নিলেও, ক্রমাগত অস্ত্রের জোগান দিয়ে চলেছে আমেরিকা এবং ন্যাটোর সদস্যরা। অর্থাৎ, যুদ্ধ থামানো বা শান্তিচুক্তি স্থাপনের থেকে, রুশ-বধই তাদের প্রধান লক্ষ। 

তবে এই কাজ পশ্চিমী বিশ্বের পক্ষে সহজ নয় বলেই মনে করছেন টড। উল্লেখ্য, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পরই তিনি জানিয়েছিলেন, সহজ ইউক্রেন দখল করতে সফল হবে না রাশিয়া। তার কারণ পশ্চিমের থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পাবে ইউক্রেন। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা সামরিক চাপের মুখেও, মাথা নত করবে না রাশিয়া। বরং, অস্তিত্বের জন্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে তারা। কিন্তু কী পরিণতি হবে এই পরিস্থিতির?

টডের মতে, ইতিমধ্যেই বদলাতে শুরু হয়েছে গোটা বিশ্বের সমীকরণ। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা পারতপক্ষে এই যুদ্ধেরই ফলাফল। বিভিন্ন ছোটো রাষ্ট্র তো বটেই, এমনকি পরবর্তীতে বিপর্যয়ের শিকার হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও। কারণ, হিসাবে টড তুলে আনছেন অন্য এক পরিসংখ্যান। রাশিয়ার জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অর্ধেক হলেও, সেখানকার ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তিবিদ্যার পড়ুয়া। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রী বিজ্ঞানে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও তার নেপথ্যে রয়েছে ভারত এবং চিনের কর্মীরা। সেক্ষেত্রে গোটা বিশ্বের মেরুকরণ ভেঙে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। তাতে শুধু যুদ্ধরাষ্ট্র একা নয়, প্রভাবিত হবে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, আইএমএফের মতো একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠনও। বিশ্বজুড়ে প্রাণহানি না হলেও, এই যুদ্ধ পরোক্ষভাবে বিধ্বস্ত করছে কোটি কোটি মানুষকে। দেউলিয়া হতে বসেছে বহু দেশ। আর এই পরিস্থিতি আরও ত্বরান্বিত হতে পারে চিনের তাইওয়ান আক্রমণে। সেই সম্ভাবনাও প্রকট বলেই জানাচ্ছেন ইমানুয়েল। সবমিলিয়ে, গোটা বিশ্বের কাছেই ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে চলেছে ভবিষ্যৎ…

Powered by Froala Editor