মার্কিন শহরের ‘নবজন্ম’ দিয়ে নোবেলের দাবিদার কলকাতার রবীন

আমেরিকার আরিজোনা স্টেটের মধ্যে টেম্পে শহর। শহরের প্রান্তিক অঞ্চলটা বছর কুড়ি আগেও ছিল অপরাধের কেন্দ্রস্থল। আজ যদিও চেহারাটা বদলে গিয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট এক বাজার। বাজারের ভিতরে ঢুকলেই অবাক হয়ে যেতে হয়। পাশাপাশি দোকানে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় পোশাক, স্পিকারে ভেসে আসছে ভারতীয় গানের সুর। এমনকি রেস্টুরেন্টের খাবার পর্যন্ত ভারতীয়। আমেরিকার বুকে এমনই এক বাজার গড়ে তুলেছেন রবীন অরোরা (Raveen Arora)। তবে শুধু বাজার নয়, বরং টেম্পে শহরের অসংখ্য শরণার্থীদের অপরাধের জগৎ থেকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। আর সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আজ তিনি রীতিমতো সফল। চলতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছেন তিনি। আবারও নোবেলের দাবিদারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল কলকাতা শহর।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন রবীন অরোরার বাবা মা। ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় তাঁর। সেইসময় কলকাতার উদ্বাস্তু শিবিরকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন রবীন। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন অভাবের তাড়না কাকে বলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন রবীন অরোরা। কিন্তু নিজের জীবনের সেই অধ্যায়কে ভুলে যেতে পারেননি। আর সেই কারণেই আরিজোনে স্টেটে গিয়ে সেখানকার মানুষের সমস্যা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। অবশ্য কোনো সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকা যাননি রবীন। ২০০২ সালে তাঁর মেয়ে আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। মেয়ের সঙ্গেই তাই সে-দেশে চলে যান অরোরা দম্পতি। সেখানে যে বাড়িটা তাঁরা কিনেছিলেন, তার পাশেই ছিল টেম্পে শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত বস্তি অঞ্চল। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই ছিল চোরাকারবারি থেকে শুরু করে ড্রাগ ব্যবসার আঁতুরঘর। তবে রবীন বুঝেছিলেন সুস্থ জীবনের সুযোগ পেলে প্রত্যেকেই পুরনো জীবন ছেড়ে চলে আসবে। আর তাই নিজের বাড়িকেই বদলে ফেললেন একটি বাজারে। সেখানে বস্তির সমস্ত মানুষদের কাজের সুযোগ দিলেন। সেইসঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির স্বাদ পৌঁছে দিলেন প্রত্যেকের কাছে।

আরিজোনা স্টেটে এমনিতেই ভারতীয়ের সংখ্যা খুব কম নয়। তাই এই বাজার জনপ্রিয় হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে এখন আর শুধু ভারতীয়দের মধ্যে নয়, বরং এলাকার সমস্ত মানুষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে জনপ্রিয়তা। তবে এই বাজারের মধ্যেই রয়েছে এক অভিনব আয়োজন। বাজারের কর্মচারীরা যেমন সকলেই আমেরিকার শরণার্থী, তেমনই বর্তমান সময়ে শরণার্থী হিসাবে যাঁরা আসছেন তাঁদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের ব্যবস্থা। বিনামূল্যে প্রায় সমস্ত পরিষেবা পাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে তাঁদের সুস্থ পরিবেশে বসবাসের সুযোগও। অসহায় পরিবারগুলোর কাছে এই সুযোগ পৌঁছে দিতে পেরে সত্যিই খুশি রবীন। তাঁর মনে পড়ে যায় ছোটোবেলার শিক্ষার কথা। যে শিক্ষা তাঁকে দিয়েছিলেন মাদার টেরেজা এবং মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

কলকাতার বস্তিতে থাকার সময়েই মাদার টেরেজার সংস্পর্শে এসেছিলেন রবীন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর। এর ঠিক পরের বছর কলকাতায় এসেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। এই দুই মানুষের প্রভাব চিরকাল থেকে গিয়েছে তাঁর মধ্যে। আর তাঁদের পথ ধরে এবার তিনিও নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবিদার। সারা পৃথিবীর প্রায় ৩০০টি মনোনয়নের মধ্যে রবীনের মনোনয়নটিকে একটু আলাদা দৃষ্টিতেই দেখতে চাইছেন অনেকে। রবীনের হয়ে সুপারিশ করেছে প্রায় ৩০টি বহুজাতিক সংস্থা। টেম্পে নগর কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি তাঁর হয়ে সওয়াল করেছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। আর এই ইন্ডিয়া প্লাজা উদ্যোগকে সামনে রেখেই রবীনের কর্মকাণ্ডের পরিমাণও তো নেহাৎ কম নয়। মার্কিন শরণার্থীদের সাহায্যের পাশাপাশি ভারতে বসবাসরত তিব্বত ও বাংলাদেশের শরণার্থীদের নিয়েও একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন রবীন। মাদার টেরেজার পর তাঁর স্নেহধন্য রবীনও কি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবেন? আপাতত সেই অন্তিম ঘোষণার জন্যই অপেক্ষা করে আছেন সবাই।

আরও পড়ুন
ম্যানগ্রোভ ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় সেরা বাঙালি আলোকচিত্রী

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছিল না রুটি খাওয়ার টাকাও, আজ বলিউডের অন্যতম তারকা এই বাঙালি