বহু কষ্টে একটি ইউএসবি হার্ড-ড্রাইভ জোগাড় করেছেন এক ব্যক্তি। তার মধ্যে আছে একটিমাত্র সিনেমা। আর তা দেখাও যাবে মাত্র একবার। কিন্তু কীভাবে দেখবেন সেই সিনেমা? বাড়িতে তো সিনেমা দেখার মতো কোনো যন্ত্রই নেই। একটিমাত্র পুরনো টেলিভিশন সেট আছে, কিন্তু তাও দীর্ঘদিনের অযত্নে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোনোরকমে সেই টিভির সঙ্গে একটি গাড়ির ব্যাটারি জুড়ে তা চালু করলেন। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করেই দেখছিলেন। তাও খবর পৌঁছে গেল পুলিশের কাছে। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। চোখে কালো কাপড় বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল দেয়ালের গায়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল অসংখ্য বুলেট। চোখে দেখতে না পেলেও মৃত্যুর আগে কানে শুনতে পেয়েছিলেন সেই আওয়াজ।
২০০৯ সালে ঘটেছিল এই ঘটনাটি। আজও অনেকের মনে আছে সেই দৃশ্য। কিন্তু কেন এমন ভয়ানক শাস্তি? তাহলে কি নিষিদ্ধ কোনো উপাদান ছিল ছবিটিতে? যৌনতা বা দেশদ্রোহিতার কিছু? একেবারেই তা নয়। খুবই সহজ সরল একটি প্রেমের গল্প বলা হয়েছিল সিনেমাটিতে। কিন্তু অপরাধ এটাই যে, সিনেমাটি বিদেশি। উত্তর কোরিয়ায় বসে দক্ষিণ কোরিয়ায় তৈরি একটি সিনেমা দেখছিলেন সেই ‘অপরাধী’। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব। এই বিশ্বায়নের যুগেও এভাবেই গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া। সিনেমা তো দূরের কথা, ইন্টারনেট পরিষেবা বা আন্তর্জাতিক টেলিভিশন যোগাযোগ কিছুই নেই সেখানে। শুধু হাতে গোনা কিছু সরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচার করা হয় রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিছু প্রোপাগাণ্ডা। কিন্তু এতকিছুর পরেও আতঙ্কিত রাষ্ট্রনায়ক কিম জং-উন। তাই সম্প্রতি আরও কঠোর আইন আনা হল উত্তর কোরিয়ায়।
শুধুই সিনেমা বা অন্য কোনো মিডিয়া ফাইল পাচারের জন্য নয়, বিদেশি শব্দ ব্যবহার বা কোনো বিদেশি আইকনের অনুকরণ করলেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে উত্তর কোরিয়ার মানুষকে। সম্প্রতি দুজন কিশোরকে বিশেষ সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারাবন্দি করা হয়েছে তাদের বাবা-মাকেও। অপরাধ? তারা এক মার্কিন পপ স্টারের অনুকরণে চুল কেটেছিল এবং জিন্সের দৈর্ঘ্য ছিল হাঁটু থেকে বেশ কিছুটা উপরে। হ্যাঁ, এটুকুই। এমন সমস্ত বিদেশি প্রভাবকেই আটকাতে বদ্ধপরিকর কিম জং-উন। নতুন আইনে বলা হয়েছে কোনো কারখানার কর্মী এমন আচরণ করলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে কারখানার মালিককেও। ছেলেমেয়ের মধ্যে বিদেশি প্রভাব দেখা গেলে শাস্তি পাবেন বাবা-মা। এভাবেই চারিদিকে এক সন্দেহের বাতাবরণ ঘনিয়ে উঠেছে।
কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কিম? পরিসংখ্যান বলছে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি বরাবরই বেশ দুর্বল। আর এই করোনা পরিস্থিতিতে তা আরও খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল মানুষের কাছে বিদেশি সিনেমা বা গান শুধুই বিনোদনের মাধ্যম। কিন্তু যাঁরা দুবেলা খেতে পান না, তাঁদের কাছে এগুলো এক অন্য জীবনের স্বপ্ন। যে জীবনের অস্তিত্বকেই তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেন না। কিম হয়তো এটাই বোঝাতে চান, এমন সুখের সমাজ পৃথিবীতে কোথাও নেই। কোথাও মানুষ ঠিকমতো আহার পান না। কোথাও মানুষ সুখে নেই। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপান বা আমেরিকার দৃশ্য পৌঁছে গেলে সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস নড়ে উঠতে বাধ্য। কিন্তু এত চেষ্টার পরেও কি বৈদেশিক বিনোদন মাধ্যমগুলিকে আটকে রাখা যাবে? গত ২০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সিনেমা পাচার বেড়েছে অনেকটাই। আগামী দিনেও কি তা সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে?
আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের খবর তুলে ধরায় জেল মায়ানমারের সাংবাদিকের
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি, আরএনজেড
আরও পড়ুন
মঞ্চে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গান, ৪৬টি গুলিতে ঝাঁঝরা হলেন ভিক্টর হারা
Powered by Froala Editor