শান্তিপুরের ঝুলন মানেই রং-বেরঙের মাটির পুতুল

শিয়ালদা থেকে ৭.২৫-এর শান্তিপুর লোকাল ধরে শান্তিপুর। প্রায় ঘণ্টা তিনেক ট্রেনে বসে থাকার ক্লান্তি ঝাড়তে এসে বসলাম স্টেশন সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানে। দোকানে তখন চায়ের জল ফুটছে সবে। অগত্যা বসে রয়েছি। এমন সময় বছর বারো কি তেরোর দুইজন হাফপ্যান্ট পরা ছেলে এসে দোকানদারকে কিছু খুচরো হাতে ধরিয়ে সুজি বিস্কুট চাইল। কাঁচের বয়ামে রাখা বিস্কুট থেকে চারটি বিস্কুট ছেলেগুলোর হাতে ধরিয়ে মাঝবয়সী ভদ্রলোকটি ছেলেগুলোর হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী রে, ক’টা পুতুল কিনলি? কী সাজাচ্ছিস এইবার?”

একজন ছেলে উত্তর দিল, “পাথর সাজিয়ে পাহাড় বানানো হয়ে গেছে। এই দেখো, সৈন্য পুতুল কিনেছি এবার। পাহাড়ের ওপর বসাব।” আমি দেখলাম, এই সুযোগ। যে পরশপাথরের সন্ধানে আমি এখনে এসেছি তার হদিশ এই ছেলেগুলোই দিতে পারবে। বললাম, “কোথা থেকে কিনলি রে এই পুতুলগুলো?” ছেলেগুলো জানাল চৌগাছা পাড়া থেকে কিনেছে। দোকানদারের থেকে জানা গেল, স্টেশন থেকে চৌগাছা পাড়ার টোটো পাওয়া যায়। মিনিট দশেকের রাস্তা, চৌগাছা পাড়া বললেই নামিয়ে দেবে। অতঃপর আর কালবিলম্ব না করে জলদি চা খেয়ে রওনা দিলাম পুতুল মানে সেই পরশপাথরের খোঁজে।

এমনিতে গঙ্গার তীরবর্তী এই শান্তিপুর অঞ্চলটি ধর্মীয় দিক থেকে বহুগুণে প্রসিদ্ধ। যার সুবাদে শান্তিপুরবাসী নানান উৎসব ও পার্বণে প্রায় সারাবছরই মেতে থাকেন। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, গনেশজননী, নেত্যকালী পুজো ছাড়াও দোলপূর্ণিমা, রাসযাত্রা তো রয়েছেই। আবার ঝুলনের সময় ঝুলনযাত্রাকে কেন্দ্র করেও এই অঞ্চলের ছোটো ছোটো কচি-কাঁচারা মেতে ওঠে পুতুল সাজানোর মজায়।

টোটো থেকে নেমে চৌগাচা পাড়ায় পা রাখতেই দেখতে পেলাম মৃৎশিল্পীদের মধ্যে ঝুলনকে কেন্দ্র করে হরেক রকমের পুতুল তৈরির ব্যস্ততা। রাস্তার দুই ধারে বাড়ির সামনে বসে মৃৎশিল্পীরা পুতুল বানাচ্ছেন। সত্যি যেন দেখে মনে হবে, লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে আসন্ন ঝুলনকে উপলক্ষ্য করে। কত রকমেরই না পুতুল-- মাছ ধরা পুতুল, চাষা-চাষি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি চালানো পুতুল, সাঁওতাল মেয়ে, ঘোড়া, হাতি, শিকারি বাঘ, মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, কঙ্কাল, বর-বউয়ের পুতুল। এছাড়াও, দেবদেবীর পুতুল হিসাবে গৌর-নিতাই, রাধা-কৃষ্ণ, হামাগোপাল তো আছেই। এমনকি, এর পাশাপাশি উঠে এসেছে  সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতীক রূপে সৈন্য পুতুল, ক্রিকেট বা ফুটবল খেলোয়াড় পুতুল, ধারাভাষ্য দেওয়া পুতুলেরা।

এই পুতুল বানাবার নেপথ্যে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজনকে পাকড়াও করলাম। নিজের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে পুতুল তৈরি করছেন। চেয়ারি (সরু বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি পুতুল গড়বার যন্ত্র) দিয়ে একমনে তৈরি করে চলেছেন একটি পুতুলের মুখ। ইনি হলেন মৃৎশিল্পী জয়দেব পাল। খানিক কথা এগোতেই জানা গেল, এই পুতুলগুলি দুইভাবে তৈরি করা হয়। কখনও ছাঁচে আলাদাভাবে দুই খোলে বানিয়ে জোড়া দিয়ে, আবার কখনো হাতের আঙুলে টিপে টিপে। পুতুল বানাতে ব্যবহার করা হয় মজে যাওয়া এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। কাঁচা মাটির পুতুল রোদে শুকিয়ে তারপরে দেওয়া হয় রঙের প্রলেপ। রং করতে এলামাটি বা খড়িমাটির সঙ্গে মেশানো হয় গুঁড়ো রং এবং গদের আঁঠা। এইভাবেই মাটির পুতুলগুলি আস্তে আস্তে রঙিন হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র জয়দেব পাল-ই নন, চৌগাছা পাড়া ঘুরে খুঁজে পাওয়া গেল রীতা পাল, দীনবন্ধু পাল, সত্যজিৎ পাল-দের মতো এমন আরো অনেক মৃৎশিল্পীদের। কেউ একমনে বানিয়ে চলেছেন মাছ-ধরা পুতুল, কেউ বা সৈন্য পুতুল।

ঝুলনযাত্রার আগেই থেকেই এই সকল মৃৎশিল্পীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় পুতুল বানানোর প্রস্তুতি। আর এখন তো দম ফেলার সময়টুকুও নেই। বার্বি ডল, ফ্যান্সি সব খেলনার বাজার তো সারা বছরই আছেই, কিন্তু ঝুলনের এইসব মাটির পুতুল দিয়ে ঘর সাজানোর মজাই আলাদা। সেই কবে থেকে এমনভাবেই ঝুলন সাজিয়ে আসছে বাংলার ছেলে-মেয়েরা। ইতিহাস জড়িয়ে রাখা এই ঝুলনের পুতুলে সত্যিই বুঁদ হয়ে আছে বিস্ময়। শিশুমন সেই বিস্ময় বুনতে বুনতেই হয়তো খুঁজে পেয়ে যায় হারানো কোনও পরশপাথর।

ছবি- লেখক।

More From Author See More