ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন যে বাঙালি ফকির

এমনকি চতুর ইংরেজও বুঝতে পারেনি, এক ফকিরের তরবারির ধার কতখানি! বোঝেনি, সেই ফকিরের নেতৃত্বের জোর সারা দেশে তাদের বিরুদ্ধে প্রথমবার বিদ্রোহ সংঘটিত করে তুলতে পারে। তবু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বা গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কিন্তু সাক্ষ্য দেয়, সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাই সম্ভব করে তুলেছিলেন মজনু শাহ। মজনু ফকির নামেও যিনি পরিচিত। যদিও তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ইতিহাস দেশের বীর সন্তান বলে যাঁদের কথা বলে থাকে, তাঁদের সঙ্গে একাসনে প্রায় কখনোই তাঁকে বসানো হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রথমবার ইংরেজদের ঘুম যিনি কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি এই মজনু ফকিরই। সেই অর্থে তিনি-ই আমাদের প্রথম বিদ্রোহী নায়ক।

দ্বিতীয় পর্ব
হাজার চেষ্টাতেও মজনু শাহ-কে ধরতে পারেনি ইংরেজরা

ইংরেজরা শোষণের কলে জোর দিতে কসুর করেনি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এল অবধারিত ভবিতব্য হয়ে। বাংলা-বিহারের গ্রামসমাজের সেই রক্ষাকবচটি এর ফলে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হল। ইতোমধ্যে বস্ত্রশিল্পীদের বুড়ো আঙুল কেটে নিয়ে শিল্পবিপ্লবের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। বাংলা-বিহার থেকে এই যথেচ্ছ লুটতরাজই গোটা দেশ দখলে প্ররোচিত করে ইংরেজদের। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে তারা ওস্তাদ-ই ছিল। ফলে বিবাদে জীর্ণ দেশীয় রাজাদের কবজা করে ভারত দখল করতে তাদের বেশি বেগ পেতে হয়নি। এর উপর জুড়ে বসল তীর্থভ্রমণের কর। মূলত বাংলা-বিহারেই। এতে ঘৃতাহূতি হল। মূলত কৃষক, বস্ত্রশিল্পী কারিগরদের মধ্যে যে ক্ষোভ সঞ্চিত ছিল, তা গতি পেল সন্ন্যাসী-ফকিরদের অসন্তোষে। এই সেই মুহূর্ত যখন সঠিক নেতৃত্ব পেলে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে পারে বিদ্রোহ। ঠিক সময়েই এগিয়ে এসে হাতে তরবারি ও নেতৃত্বভার তুলে নিয়েছিলেন মজনু শাহ।

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই বিদ্রোহীরা ইংরেজদের জব্দ করতে শুরু করে। প্রথমে দখল করা হয় ঢাকার ইংরেজ কুঠি। রাতের অন্ধকারে ফকির-সন্ন্যাসীরা গিয়ে কুঠি ঘিরে ফেলে। ইংরেজরা প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে গা ঢাকা দেয়। ক্লাইভ তো এই ঘটনায় এত চটে যান যে, কুঠির প্রধানকে বরখাস্ত করেন। বেশ কয়েক মাস পরে সে-কুঠি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয় ইংরেজরা। এরপরও বেশ কয়েকটা কুঠি দখল করেন বিদ্রোহীরা। অনুমান করা হয়, এগুলোর নায়ক ছিলেন কোনো এক ফকির। অন্যদিকে দিনহাটায় ইংরেজ লেফট্যানান্ট মরিসনের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ বাধে সন্ন্যাসীদের। এই যুদ্ধে সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দেন রামানন্দ গোঁসাই। এবং মরিসনের বাহিনী সন্ন্যাসীদের কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ইংরেজের টনক নড়ে। মন্বন্তরের পর বিদ্রোহীরা ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে হারতে থাকে। এমনকী মজনু শাহের নেতৃত্বেও একবার পরাজয় বরণ করে বিদ্রোহীরা। এখান থেকেই মূলত মজনু ফকিরের নেতৃত্বের দৃঢ়তা আমরা লক্ষ করব। তিনি দমে তো যাননি, উলটে ছত্রভঙ্গ বিদ্রোহীদের পুনরায় সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে নেমে পড়েন।

মজনু চেয়েছিলেন, কৃষকদের সঙ্গে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে যেন ঐক্যবদ্ধ হন জমিদার শ্রেণীও। নাটোরের জমিদার রানি ভবানীকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এর উল্লেখ আমরা পাই সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইটিতে। মজনু লিখেছিলেন, ‘পূর্বে ফকিররা একাকী ভিক্ষা করিয়া বেড়াইত, এখন তাহারা দলবদ্ধ হইয়াছে। ইংরেজরা তাহাদিগের এই ঐক্য পছন্দ করে না। তাহারা ফকিরদের উপাসনায় বাধা দেয়। আপনিই আমাদের প্রকৃত শাসক, আমরা আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করি। আপনার নিকট হইতে আমরা সাহায্য লাভের আশা করি।” রাজনৈতিক বার্তা স্পষ্ট। যদিও এ আবেদনে ফল মেলেনি। তথাপি মজনু বসে থাকেননি। দেশীয় কামারশালে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েই তাঁর বাহিনী তৈরি করেছিলেন। এরা গেরিলা যুদ্ধেও ছিল পটু। জমিদার ও ধনী শ্রেণির মানুষের সম্পদ লুট করত। গ্রামবাসীরা এদের সহায় ছিল। তারা জমিদারকে রাজস্ব না দিয়ে তুলে দিত মজনু ও তাঁর বাহিনীর হাতে। ফলে রাজস্ব আদায়ে বিরাট ঘাটতি দেখা গেল। তখন কী ছিল ইংরেজদের প্রতিক্রিয়া?

(ক্রমশ)

দ্বিতীয় পর্ব
হাজার চেষ্টাতেও মজনু শাহ-কে ধরতে পারেনি ইংরেজরা

More From Author See More