'জীবনানন্দ, ঋত্বিক ও মানিককে নিয়ে হতে পারত জী-মা-ঋ ক্লাবও'

কথক-শ্রোতার কথা

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় কলকাতাবাসীদের কাছে এবং সমগ্র বাংলাভাষীদের কাছে ‘মডার্ন ইন্টেলেক্ট’-এর একাগ্র ভাষ্যকার, আধুনিক বঙ্গ-সাংস্কৃতিক মেজাজের দায়ভার বহক ও চিন্তক। পেশায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাছাড়া বছর তিনেক সরকারী চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রশিক্ষণ সংস্থা ‘রূপকলা কেন্দ্রের’ অধিকর্তাও ছিলেন। বাঙালি মননে 'ঋত্বিক-তন্ত্র' স্থাপন ও উদযাপনে কাটিয়েছেন কর্মজীবনের বিপুল সময়। সে-কাজের নৈপুণ্য তাঁকে ঋত্বিক মানসপুত্র হিসাবেও আখ্যায়িত করেছে বঙ্গ-সাংস্কৃতিক পরিসরে। আবার অন্যদিকে তার নিজেরই কথায়, ‘সিনেমা ইজ এ কনভিনিয়েন্ট ওয়েপন, কিন্তু একমাত্র হাতিয়ার নয়।’ তাই আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আঙিনার প্রায় সমস্ত পরিসরেরই বাংলা ভাষার অতি পরিচিত আলোচক-মন্তব্যকারী সঞ্জয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় মেধা-প্রোজ্জ্বল নিয়মিত লেখালেখি ছাড়াও, প্রকাশ করেছেন প্রায় দশটি বই। সঞ্জয়ে মুখোপাধ্যায়ের লেখা কয়েকটি বইয়ের নাম হল 'স্থানাঙ্ক নির্ণয়', 'অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন', 'অনভিজাতদের জন্য অপেরা' ইত্যাদি। তার অনূদিত চিত্রনাট্যের মধ্যে 'দ্য ৪০০ ব্লোজ' সহ আরো ছটি সিনেমার ইতিবৃত্ত রয়েছে। এছাড়া 'বুনো স্ট্রবেরি' এবং 'ওগো মায়া ওগো বাতায়ন' তাঁকে এক অন্য ধরনের ঔপন্যাসিক হিসাবেও প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। 

রূপক বর্ধন রায় পেশায় বিজ্ঞানী। প্রায় এক দশকের প্রবাসযাপন তাঁকে তাঁর মননের ভাষাকে আরো আপন করেছে। নিজের আনন্দ এবং ভালোবাসা থেকেই বিভিন্ন ওয়েবজিন এবং পত্র পত্রিকায় ইতিহাস, বিজ্ঞান, ঘোরাঘুরি ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন। এছাড়াও বিশ্ব-সাহিত্য, গানবাজনা, নোটাফিলির মতো বিস্তর বিষয়ে রূপকের গভীর আগ্রহ।

কথোপকথন

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরাসি সিনেমা, শিল্পীর আত্মানুসন্ধান ও অস্তিত্ব-সংকট

রূপক : আমার মতো আরো বহু মানুষ আছেন যারা আপনার সম্পর্কে, আপনার কাজ, আপনার পড়াশোনা সম্বন্ধে, আরো খানিকটা গভীর ভাবে জানতে ইচ্ছুক। কাজেই আমার প্রথম প্রশ্ন আপনাকে ঘিরে। আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র ছিলেন, এবং তারপর সংস্কৃতির আঙিনায় চলে আসেন। এরপর ফিল্ম স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট স্থাপন এবং আরো অন্যান্য নানান কাজে বিরাট অবদান। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়াই বা কেন এবং তারপর শিল্প-সংস্কৃতির দিকে চলে আসার পেছনে কার বা কীসের প্রভাব?

আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ

সঞ্জয় : দেখো সব সভ্যতারই তো একটা মফস্বল থাকে! আমরা যারা বাঙাল, কলকাতা তো তাদের হাইকোর্ট দেখাবেই। খুব সোজা করে বললে, আমাদের দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বা বিজ্ঞান পড়া, মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বাভাবিক পরিণতি। চাকরি বাকরি পাওয়া অনেক বেশি সোজা এবং অনেক নিরাপদ ভবিষ্যৎ বলেও মনে হয়। এখন মনে হয় আমি থিওরিটিকাল ফিজিক্সের দিকে গেলে ভালো করতাম। কারণ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রথম বছরেই, থিওরিটিকাল ফিজিক্সের কোয়ান্টাম মেকানিক্স, লোরেঞ্জ ট্রান্সফরমশান রেশিও, স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি, দ্য-ব্রগলি ওয়েভ, থিওরি অফ আনসারটেইনিটি, ইত্যাদি জায়গাগুলো, মানে এইযে বিজ্ঞান পালটে গেল এইটা আমাকে খুবই আকর্ষণ করেছিল। 

আরও পড়ুন
স্কুলবেলা থেকেই সিনেমার জন্য লড়াই, ‘এশিয়ান’-এ স্থান পেলেন বাঙালি পরিচালক

যেমন আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, যে বছর মাক্স প্লাঙ্ক প্রথম এক্সপেরিমেন্ট টা করলেন, ১৯০০ সালে, সে বছরই ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশান অফ ড্রিমস’ ছাপা হল। অর্থাৎ এইযে কনশাস এবং আনকনশাস, দুটোই কিন্তু বিজ্ঞান থেকে আসছে। অর্থাৎ যা বাস্তব, বা চোখে দেখা যায়, এইযে রূপক আমাকে দেখছে বা আমি রূপককে দেখছি এই দেখার চোখটা পালটে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আর বিশেষ ইন্টারেস্ট পাচ্ছিলাম না।

আরও পড়ুন
কিম কি-দুক : অধ্যাপক-চলচ্চিত্র সমালোচক মানস ঘোষ ও সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের চোখে

দ্বিতীয় কথা আমাদের যুগটা ছিল রাজনীতির। একটা না-বলার যুগ। আমাদের বাড়িতে আমি আর আমার দাদা একসঙ্গে একই ঘরে থাকতাম। দাদা ইংরেজিতে এম-এ পড়তেন এবং আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন ছিলেন। তার ঘরে আমি এলিয়ট,কাফকা,কামু এসব প্রথম দেখি… কিছুটা পড়িও।

রূপক : এটা কোন সাল? আপনার তো যাদবপুর ছিল?

সঞ্জয় : ’৬৭, ৬৮ এরকম হবে। হ্যাঁ যাদবপুর। 

কাজেই, না বুঝে বা বুঝে, আন্দাজে পড়ে ফেলেছিলাম টি এস এলিয়টের একটা লেখা ‘ট্র্যাবডিশানাল ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’। খুব মানে বুঝিনি কিন্তু ভাল লেগেছিল। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কে গায় ওই’ বা ‘একটি গীত’(আমি কমলাকান্তের কথা বলছি) খুব ভালো লেগেছিল। আমি যখন হায়ার সেকেণ্ডারিতে তখন প্রথম জীবনানন্দ দাশের বই কিনি। জীবনানন্দ দাশ পড়ে আমার জগৎটাই পালটে গেল। এমনকি যাদবপুরে ঢুকে আমি দেখলাম বামপন্থী বইয়ে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে সেগুলো অনেক পুরনো বামপন্থা, এমনকি মার্ক্সও খুব যে পছন্দ করতেন এমন নয়। ছাঁচে ঢালা মনে হল। খালি কডওয়েল একটু টেনেছিল।

ধরো অর্জুনকে দ্রোণাচার্য প্রশ্ন করলেন ‘তুমি কী দেখছ?’ অর্জুন বলল, পাখির চোখ। আমার মনে হয় এটা এক রকমের দেখা ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগ মানে, টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির সেকেন্ড হাফ থেকে শুরু করে এই সময় অবধি এটা আর দেখা নয়। আমি সমগ্র বনটাই দেখতে পাচ্ছি। এই যে বিজ্ঞানের ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বা বায়োলজির বিভিন্ন ভাগ অলীক হয়ে গেল, আমার মনে হল আর্টসেও, আমি এইভাবে বাস্তবকে দেখতে চাই। একটা কথাকে নানাভাবে বলা যেতে পারে, ফ্রম অল পসিবল এ্যাঙ্গেলস। কাজেই সেটা কীভাবে বলব? বাঙালিমাত্রেই কবিতা লেখে, আমিও লিখেছিলাম দু চারটে (হাসি)…

ভাবতে ভাবতে দেখলাম সিনেমা ইজ এ কনভিনিয়েন্ট ওয়েপন, কিন্তু একমাত্র হাতিয়ার নয়। এইখানে এটা বলতেই হবে যে ১৯৬৮ সালে ঋত্বিক ঘটক যাদবপুরে আসায়, আমরা প্রথম বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারকে দেখলাম যিনি সিনেমা নিয়ে ভাষণ দিলেন কিন্তু সিনেমার একটা কথাও বললেন না। ইতিহাস নিয়ে বললেন। আমরা বুঝতে পারলাম সিনেমা নিয়ে কথা বলা ইতিহাসের সূত্রে যায় বা ইতিহাস নিয়ে কথা বলা সিনেমার অছিলায় যায়। সিনেমাটিক দেখা নিয়ে একটা কবিতা লেখা হচ্ছে;

‘তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল
দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব -
শ্যামলী, করেছি অনুভব।’

তুমি দেখো প্রিন্সিপাল ক্লজ হচ্ছে; তোমার মুখের দিকে চেয়ে অনুভব করেছি, সাপোর্টেড বাই ডিটেইলিং অফ ডিফারেন্ট শটস। এখন এইযে নানা রকম জিনিসের মধ্যে ঢুকে পড়া, এটাই ইন্টারটেক্সটচুয়ালিটি। 

রূপক : খানিকটা ফিজিক্সের আলটিমেট এইম, মানে গ্র্যাইন্ড ইউনিফিকেশনের মতো দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা তাই না?

সঞ্জয় : হুম। ১৯০৭এ পিকাসো ‘দেমোয়াজেল দে আভিগনা’ আঁকছেন, এইযে পাঁচটা নুডকে ভেঙেচুরে নানান ভাবে দেখা সেটা দা ভিঞ্চির ব্যালান্সড ফ্রেমকে, পরিপ্রেক্ষিতকে চ্যালেঞ্জ করল। রেনেসাঁ আমাদের বুঝিয়েছিল আপনি মানুষ আপনি সর্বোচ্চ জীব আপনি দেখতে পারেন। ‘হোয়েদার ইট ক্যান বি সিন?’ যে প্রশ্নটা উপনিষদে আছে সেটা এবার বিজ্ঞান করল। ধর্মের শূন্যস্থান বিজ্ঞান পূর্ণ করে দিল।

১৯২১ সালে টি এস এলিয়ট একটা কবিতা লিখছেন, সে কবিতায় বেশিরভাগ লাইনই ওনার না। ইটস এ কোলাজ। তার এত রেফারেন্স যে তুমি আজকে সায়েন্সের পেপার যেভাবে লেখো সেভাবে একটা কবিতা লেখা হয়েছে।

এই যে আসতে আসতে একটা নলেজ ডোমেইনের মধ্যে শিল্প ঢুকতে শুরু করল, এবং শিল্প এ্যাডমিট করল সে শুধু একটা সম্ভাব্যতা, এইটা আমায় টানছিল। আমার এই সম্ভাব্যতার নন্দন-তত্ত্ব হিসাবে জীবনানন্দ দাশকে, ঋত্বিক ঘটককে এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুব সিগনিফিকান্ট মনে হয়। (হেসে) জী-মা-ঋ ক্লাব বলতে পারো।

রূপক : আপনার কলেজ জীবনে রাজনীতির প্রভাব কতটা? তার কতটাই বা এ্যাক্টিভ?

সঞ্জয় : আমাদের যুগে নেগেট করার জন্য লেফট র্যা ডিকালিজম একটা ফ্যাশান ছিল। কাজেই কিছু এ্যাক্টিভলিও জড়িত ছিলাম। 

আমার কাছে মূল জায়গা ছিল অন্য। ১৯৬৮-তে ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলন বা সেকেন্ড ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশান অনেক বিষয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছিল। তাতে আমার মনে হয়েছিল রাজনীতি আমার কাছে প্রশ্ন তৈরি করার একটা সুবিধাজনক রণকৌশল হবে। এই জিজ্ঞাসাগুলো তৈরি করতে গিয়ে আমি দেখেছি, যেমন, মার্ক্সবাদী রাজনীতির ট্র্যাপডিশানাল জায়গাটাও আমাকে সন্দেহ করায়। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি বলতে কী বোঝায়? তখন ভেবেছি এইভাবে লিখতে হবে ওইভাবে লিখতে হবে কারণ এটাই জনগণের সাহিত্য। কিন্তু কে জনগণের সাহিত্য? কার জনগণের সাহিত্য? আমার মনে হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাড়ে সাত সের চাল’ তথাকথিত জনগণের সাহিত্য হতে পারে না, যদিও দলীয় রাজনীতি তা বলার চেষ্টা করেছে। ‘মা তুমি ল্যাংটো’ এই ভায়োলেন্ট রিয়ালিটি চলতি মার্ক্সিজম এ্যালাউ করে না। আমি বুঝেছিলাম মার্ক্সিজমের ভিতরেও একটা সাবভার্শান চালাতে হবে নাহলে মার্ক্সিজম যেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা একটা স্টেল প্রাতিষ্ঠানিক ডগমা। এবং সে-কারণেই তার পতনও হল। 

কিন্তু এই বিষয়ে বলতে হবে এই বামপন্থী রাজনীতি আমাদের প্রশ্ন করায় উৎসাহ দিয়েছিল এবং কতগুলো কনভেনশানাল স্ট্রাকচারকে ইন্টারোগেট করার সাহস যুগিয়েছিল।

রূপক : কয়েকদিন আগে এইসময় কাগজে জিজেকের ‘প্যাণ্ডেমিক’ বইটার রিভিউ লিখেছিলেন। বইটায় বলা তত্ত্বকে নিও-সোশালিজম বা নিও-কমিউনিজম যাই বলা হোক না কেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই পোস্ট মিলেনিয়াল জেনারেশান, যার একটা বিরাট অংশের কাছে সময় বের করে একটা বই পড়াই বিলাসিতা, তার কাছে এ-তত্ত্ব কতটা কন্টেক্সটচুয়াল? ওয়াট ইজ দা ওয়ে আউট? এদের কাছে পৌছবে কী করে?

সঞ্জয় : ওয়ে আউট আমি জানি না। মার্ক্সের যে প্রথম লেখা, ‘ইকনমিক অ্যান্ড ফিলোজফিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস অফ ১৮৪৪’, (মানে প্রেমপত্র এবং কবিতা বাদ দিয়ে বলছি) তাতে উনি এই এ্যালিয়েনেশানের কথাটা বলেছেন। এই পোস্ট মিলেনিয়ালদের সঙ্গে আমরা ভাবলাম এই বিচ্ছিন্নতাটা একটা ওয়েলকাম সিচুয়েশান, যেখানে ম্যান ক্যান ডেয়ার টু ইন্ডিভিজুয়েট হিমসেল্ফ। কিন্তু সেটা হতে গিয়ে, ইন আ হিসটোরিকাল কনটেক্সট, যেটাকে আমরা এখন সোশাল ডিসট্যানসিং বলছি, সেটা একেবারে ইন্ডিভিজুয়াল ডিস্ট্যান্সিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাফকার লেখায় যে এ্যালিয়েনেশান, সেটাও অবাস্তব হয়ে যায় যদি আমরা এখন বাকি বিশ্বের শহরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার এলিট সোসাইটিকে দেখি। উই ডোন্ট বিলিভ ইন ফিজিকাল প্রেসেন্স, উই বিলিভ ইন ভার্চুয়াল রিপ্রেসেন্টেশান। 

রূপক : সেখানে তো পরিস্থিতিটাও গুরুত্বপূর্ণ তাই নয় কি? এই আমার আপনার কাছে এ ছাড়া তো অন্য কোনো উপায় থাকছে না। সেই ক্ষেত্রে রিপ্রেজেন্টেশান তো অনেকটাই সাহায্য করে।

সঞ্জয় : তা খানিকটা হয়তো করে, কিন্তু স্পর্শের যে প্রভাব, এইযে জিজেক বইয়ের শুরুতেই মেরি ম্যাকদালেনের কথা বলছেন বা এই যে বঙ্কিম চন্দ্রের লেখায় কানা ফুলওয়ালি রজনীকে প্রথম পুরুষ স্পর্শ, এই স্পর্শের অভাব বা লস অফ সেন্সারি অর্গান শুরু হয়েছে। এই জায়গা থেকে আমি ভাবছি নতুন করে মানুষের চিন্তা বা অন্য কিছু যদি তৈরি হয়। আসলে মানুষ একটা এ্যাবসলিউটের সঙ্গে সুর গাঁথতে চায়, সেটা ভেঙে যাচ্ছে। সেই ভেঙে যাওয়া থেকেই তার যাবতীয় হাহাকার। 

আসল কথা হল একটা বড়ো অস্তিত্ব আর একটা ছোট এগজিসটেন্সকে কী করে জুড়ব আমরা? বিরাট একটা দর্শন তৈরি হওয়ার জায়গা এটা। আমি এ ব্যাপারে যথেষ্ট কেপেবল নই, কিন্তু আমি দেখছি ইউরোপ আমেরিকায় এ-ব্যাপারে বেশ কিছু লেখালেখি শুরু হয়েছে। আমরা বিগত ৫০০ বছর ধরে জেনে এসেছি যে মানুষ যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারে। আর আজ ২০২০তে এসে আমাদের মনে হচ্ছে এই যুক্তির স্ট্রাকচারটাই ভেঙে পড়ছে। উই শুড হ্যাভ আ ডিফারেন্ট ওয়ে অফ সিয়িং। কিন্তু সেটা কি আমি জানি না। এটা একটা ভীষণ কন্টেসটিং সিচুয়েশান।

রূপক : সম্প্রতি আপনার একটি লেখায় মায়া ও সেই সূত্রে সার্ত্রের প্রসঙ্গ পড়লাম। আপনার কী মনে হয়, সার্ত্রের ‘ম্যান ইজ দা ফিউচার অফ ম্যান’ কি শহুরে স্মার্টফোনে অন্তত পৌঁছে দেওয়া যায় না? মায়ার প্রয়োজনটা কোথায়?

সঞ্জয় : ঠিকই, কিন্তু এই যে তুমি হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে মানব স্তরে তুললে, প্রাণী এবং কালচার মানুষকে মানুষের রূপ দিল, এই কালচারাল কন্টেক্সটটা নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিৎ। আমরা যে ইন্ডিভিজুয়ালিজমের কথা বলছিলাম, ধরো এই যে সত্যজিৎ রায়ের অপু আলাদা হয়ে গেল, তাতে যেমন অনেক উপকার হল, কিন্তু এই আলাদা হতে হতে আমরা এমন একটা জায়গায় এলাম ইট বিকেম এ ডাঞ্জিয়ান হোল। সেখানে আমরা ক্লোজেটেড বসে আছি। এই রুদ্ধতার থেকে মুক্তির জন্য একটা মায়া কোথাও যেন দরকার। 

রূপক : সেটা তো ধর্মবিহীন স্পিরিচুয়ালিজম হতে পারে সঞ্জয়দা। সেখানে তো উপনিষদ, বা বাইবেল বা কোরানের প্রয়োজন নেই। 

সঞ্জয় : না দরকার নেই। দর্শন দরকার। আমি বলছি না তুমি গিয়ে বাইবেল পড়ো, বা গীতা পড়ো বা কোরান পড়ো, ওসবের মধ্যে আমি নেই। আমার বক্তব্য হচ্ছে তুমি এগজিসটিনশিয়ালি নিজেকে দেখো, শুধু মাত্র ইন্সট্রুমেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হোয়ো না। 

রূপক : এমনই আপনার হালের নানান লেখায় আমি এ্যাঙ্গুইশ-টা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি কিন্তু ‘সীতার ছেলের ক্লান্ত ঈশ্বরের হাত ধরে টানতে টানতে নতুন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া’, এই আশাটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। একি পাঠক আমি-র ভুল নাকি এই করোনা কালে কোথাও একটা বিষণ্ণতা কাজ করছে? নাকি এ-ব্যবস্থার উপর একেবারে আর ভরসা পাচ্ছেন না?

সঞ্জয় : আমার মনে হয় আমার ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা একটা অস্থায়ী অবসন্নতা। আমরা এই মুহূর্তে একটা ট্যাঞ্জিবল ক্রাইসিসে আছি। আজ থেকে ২৫ বছর আগে মার্ক্সিজম একটা বাস্তব প্র্যাতক্সিস ছিল, সেটা একেবারে ব্যার্থ হয়ে গেছে এবং চুড়ান্ত রাইট উইং ইজ অন দি রাইজ। সেখানে বলতে পারো স্মৃতি খানিকটা হতাশা হিসেবে কাজ করছে। 

কিন্তু এটা স্থায়ী নয়। আমি বরং মনে করছি এইযে উই আর ইন দি টোয়েন্টিজ, এই কুড়ির বছর এসে আমাদের উদ্ধার করবে। এতদিন আমরা বুড়োদের উপর নির্ভর করতাম, এস্টাব্লিশমেন্টকে ভাবতাম জিপিএস, এখন ভাবছি উই উইল স্টার্ট ফ্রম জিরো, সেটা হয়তো ভুলভাল হবে তবু এই জিনিসটা আমাদের দরকার। কাজেই এটা তো আশারই কথা। আশা বলতে আমি ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’, ‘হোক কলরব’ বা ‘ জামিয়া মিলিয়া’ মতো ঘটনার কথা বলছি।

আমরা ভেবেছিলাম মতাদর্শের শূন্যতা আসছে এবং ইতিহাস শেষ হয়ে যাচ্ছে যখন, তখন আমরা আমাদের নিজের রাস্তায় হাঁটব। এই যেতে গিয়ে আমরা খেয়াল করলাম না অন্যদিক থেকে অন্যকিছু আসছে। একটা সার্ফেস লেয়ার সত্যকে নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। তাতে এই ধরণের ধাক্কা না জানিয়ে আসতেই পারে।

রূপক : আমার নিজের ভীষণ কাছের একটা জায়গা, সেটা হল লিঙ্গ রাজনীতি। আপনার মনে হয় না যে ভারতবর্ষের কন্টেক্সটে ক্লাস স্ট্রাগলের থেকেও তার গুরুত্ব বেশি? আমরা যদি থিওরিটিকালি ধরে নিই যে নিও-সোশালিজম এসে পড়েছে, সেক্ষেত্রেও আমাদের দেশের কটা বাড়িতে গরম খাবারের উপর পুরুষ নারীর সমান অধিকার থাকতে পারে?

সঞ্জয় : না হয় না তো। অসম্ভব অসমতা আজ অবধি। এই করোনাকালে সেটা আরো বেড়ে গেছে। আমার মনে হয় এর থেকে একটা বড় বিপর্যয় আসা সম্ভব। সেটা আর্থিক শুধু না, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও ব্যাপক। বেসিক গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটাও নেই। 

তবে এটাও কিন্তু ক্লাস স্ট্রাগেলের অঙ্গই। আমরা এখন জেন্ডার পলিটিক্স, রেশিয়াল পলিটিক্স বা অন্যান্যগুলোকে আলাদা ভাবি। এও ঠিক একজন গরিব শ্রমিকও বাড়িতে পেট্রিয়ার্কি চালাচ্ছে, মদ খেয়ে এসে বউকে মারছে, কিন্তু ম্যাক্রোস্কেলে দেখলে বুঝবে শ্রেণী শোষণ নানান রূপে প্রকাশিত হয়, এমনকি একই কাজ করে একজন পুরুষ এবং নারী এক মজুরি পাচ্ছেন না। একটা ভারী কাজ পুরুষের জন্য এবং হালকা কাজ মহিলাদের জন্য, কিন্তু একটু ডিপলি ভাবলে দেখবে হালকা কাজটা অত হালকা নয়, মুখে বলার জন্য হালকা।

রূপক : তাহলে আপনি ভারতের পার্স্পেকটিভে কোন সমস্যাটাকে বেশি জোর দেবেন? একটার সমাধান করতে গেলে অন্যটার সমাধান তো করতেই হবে।

সঞ্জয় : তা হবে। তবে আমার ধারণা যদি আমরা ক্ষুধার সমস্যা, যেটা বেসিক, সেটাকে এ্যাড্রেস করি তাহলে তার থেকে যে ইন্টেলেকচুয়াল স্পেস তৈরি হবে তার থেকে এই জেন্ডার পলিটিক্সের সমস্যাটাকেও সামলাতে পারবো। নাহলে একথা শুধুই আরূঢ় ভণিতা। 

রূপক : এবার একটু অন্যদিকে যাই। প্রথমত জানতে চাইব, ঋত্বিক ঘটক সম্বন্ধে আপনার এই অসীম আগ্রহের জন্ম কোথায়?

সঞ্জয় : ওই যে বললাম, ওঁর ছবি দেখতে গিয়ে আমার মনে হল ছবিগুলো ফিল্মের প্রচলিত নোশানকে ধাক্কা মারছে। 

হি ইজ ট্রাইং টু রাইট আ থিসিস অন দি স্টেট অফ হিউম্যান এগজিসটেন্স।

তিনি ইতিহাসের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করে দেখতে চাইছেন। যেমন ‘অযান্ত্রিক’ আমার চোখ খুলে দিল। ওটা প্রথম একটা ছবি যা ট্রাইবালদের সাথে একেবারে মর্ডান নোশান অফ অটোমোবাইল জুড়ে দেখতে চাইছে যে কী হতে পারে। একটা ইনক্লুসিভ হিস্টোরি। এবং দেখবে ওঁর চরিত্রগুলোর কোনো বাড়ি নেই, ঠিকানা নেই। যেমন অযান্ত্রিকের বিমল। মেঘে ঢাকা তারা, বাড়ি থেকে পালিয়ে, সূবর্ণরেখা এসবে তো নতুন বাড়ি, নতুন জায়গার কথা আছেই এমনকি শেষ ছবি যুক্তি-তক্কো-গপ্পোতেও একজন পথিক হিসাবে তার ভ্রাম্যমাণতা দেখানো হয়। এটাকে যদি আন্তোনিওনির সঙ্গে তুলনা করি তাহলে ইউরোপের যে একটা চূড়ান্ত এ্যালিনিয়েনেশান তার সঙ্গে ভারতের ফিজিকালি আপরুটেড হওয়ার যে সমস্যা, দুটো কোথাও একাত্ম হয়ে যায়। এই যে ভারতে ‘দূরে কাছে কেবলই ঘর ভাঙে, গ্রাম পতনের শব্দ হয়’ এটাকে ঋত্বিক কোথাও ইউনিভার্সালাইজ করতে পেরেছিলেন। 

তাছাড়া আমার বা তোমার কাছে পার্টিশান, পানিপথের যুদ্ধের মতো হিস্টোরিকালি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের সেভাবে টাচ করে না। সেখানেই আমাদের ঋত্বিকের ছবিকে প্রয়োজন। ইফ ইউ ওয়ান্ট টু রিডিফাইন ওয়াট হ্যাজ অলরেডি বিন ডিফাইনড, সেক্ষেত্রে ঋত্বিক তোমায় একটা সেরিব্রাল টুল দিতে পারেন। 

রূপক : ‘ঋত্বিকতন্ত্র’ পড়তে গিয়ে আমার একটা জায়গাতেই খটকা লেগেছিল। আমি রিভিউটাতে লিখেওছিলাম। গোদার ও ঋত্বিক দুজন একই মনস্তত্বের হলেও আলাদা ভাবে একে অপরের প্রভাব ছাড়া বেড়ে উঠেছেন। সেখানে আমার এ্যানালিসিসটার শেষে পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে আপনি কোথায় যেন ঋত্বিককে একটা এজ দিচ্ছেন। সেটা কেন? 

সঞ্জয় : আমি জানি। তোমার প্রশ্নটা ছিল ঋত্বিক আগে ভেবেছেন এই কথাটা বলবার কি প্রয়োজন ছিল? আসলে আই ওয়াজ ডিফেন্ডিং এ লস্ট কজ। ঋত্বিক তখনও অবধি খুব বেশি আলোচিত নন। শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, ঠিক তার এক বা দু মাস বাদে ঋত্বিক ঘটক মারা যান। গোদার তার ইউরোপিয়াম সার্কেলে এবং অন্যত্র, তখনই এ্যাপ্রিশিয়েটেড। এমনকি এখানেও! বিকজ অফ আওয়ার কলোনিয়াল লেগাসি আমরা প্যারিসে বৃষ্টি হলে কলকাতায় ছাতা খুলি! কিন্তু ঋত্বিকের বিষয়ে তো কেউ ভাবেনি। আমি দেখাতে চাইছিলাম যে গোদার যেমন বোঝাতে চাইছেন ফিল্ম একটা অডিও ভিজুয়াল লিখন পদ্ধতি, ঋত্বিক ঘটকও তেমনই একটা দার্শনিক ডিস্কোর্সকে ইমেজ দিয়ে রিপ্রেসেন্ট করেছেন। 

রূপক : উনি নিজেও তো নাটক আর সিনেমার চিত্রনাট্যের তুলনা টেনে বলেছেন যে নাটক মানুষ সাহিত্য হিসেবেও পড়তে পারে যেটা চিত্রনাট্যে কঠিন।

সঞ্জয় : হ্যাঁ। নাটক তুমি না দেখেও পড়তে পারো। কিন্তু চিত্রনাট্য অনেকটা স্কেলিটনের মতো। ওতে রক্ত মাংস না লাগলে ঠিক বোঝা যায় না। 

আমি ১৯৭৩-৭৪এ ছাত্র হিসাবে গোদারের মাস্কুলাঁ-ফেমিনাঁ অনুবাদ করি, তখন কলকাতায় গোদার চর্চা অলমোস্ট জিরো এবং তা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ‘আর্ট এ্যাণ্ড লিটেরারি সোসাইটি’র ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। এটা করলাম কেন? কারণ ছবিটার মধ্যে দিয়ে উনি সেসময়ের প্যারিসের মানুষদের ডিসকন্টেন্টটা ধরতে চাইছেন। প্রেমের গল্পটা এমন একটা খবরের কাগজ হয়ে গেছে যেখানে কখনও কখনও ফুল ফুটেছে আবার কখনও কখনও বিস্ফোরণ হয়েছে।

রূপক : ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে আরেকটা প্রশ্ন করি। খসরু সাহেবের সঙ্গে একটা ইন্টারভিউতে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘...আমি বার্গম্যানকে জোচ্চোর বলেছি।’ তার একটা কারণ হিসেবে বলছেন ‘মিথের ব্যবহার অন্যান্য সমসাময়িক পরিচালকেরা করলেও তাকে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ্যানালিসিস করেছেন। কিন্তু এ ব্যাটা তো পেছনে নিয়ে যাচ্ছে।’ কথাটার সঙ্গে আপনি কতটা একমত? 

সঞ্জয় : বার্গম্যানকে উনি একবার হিন্দুস্থান টাইমসে প্রচুর গালাগাল দিলেন। তারপরের দিন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে উনি বার্গম্যানের একটা ছবি নিয়ে আলোচনা করবেন। শুরু করেছেন। হঠাৎ পি কে নায়ার, যিনি পরে পুনে ফিল্ম আর্কাইভের ডিরেক্টর হন, হঠাৎ আঙুল তুলেছেন। ঋত্বিকদা ওঁর কথার মাঝখানে কথা হলে ভীষণ রেগে যেতেন। হি ট্রায়েড টু ইগ্নোর ইট। নায়ার ওয়াজ পার্সিসটেন্ট। উনি বললেন, ‘ইয়েস নায়ার?’ নায়ার বললেন, ‘স্যার, দা আদার ডে ইউ টোল্ড দ্যাট বার্গম্যান ইজ এ্যান আর্ক রিঅ্যাকশানারি। অ্যান্ড নাউ ইউ আর সেয়িং হে ইজ গ্রেট। হাউ ক্যান দিস বি রিকনসাইল্ড?’

ঋত্বিকের একটা বিখ্যাত রসিকতা আছে, আমি কুমার সাহানির কাছ থেকে শুনেছিলাম, উনি বললেন, ‘দ্যাটস বিটুইন মি অ্যান্ড বার্গম্যান। বাট ফর ইউ হি ইজ গ্রেট।’ (হাসি)

আসলে ঋত্বিকের বার্গম্যান নিয়ে কথাবার্তার একটা অংশ আমরা শুনি। হি ওয়াজ এ গ্রেট এ্যাডমায়ারার অফ বার্গম্যান। ওনাকে কখনই অর্ডিনারি চিট ভাবেননি। হি শেয়ারস সো মেনি থিংস উইথ বার্গম্যান। এটা শ্রদ্ধার থেকে আপত্তি করা। 

রূপক : আরেকটা প্রশ্ন, তা হল ঋত্বিক ঘটকের মাদার কমপ্লেক্স। একাধিক আলোচনায় উনি সেটা বলেছেন। ‘মিথিকাল মাদারহুড’ বলা যায় কিনা জানি না। কিন্তু ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ বা ‘সুবর্ণরেখা’র মাদার কমপ্লেক্সের সঙ্গে ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার কনশাস স্ট্রাগলটার মধ্যে কোথাও কন্ট্রাডিকশান নেই?

সঞ্জয় : কন্ট্রাডিকশান হয়তো নেই তবে একটা ডিফারেন্স অবশ্যই আছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় গীতা দে অভিনীত নিষ্ঠুর মা এবং নীতার মধ্যেকার বেনাভলেন্ট মাদার এই দুজনকে তুমি একটা কম্পলিমেন্টারি এগজিসটেন্স হিসাবে ভাবতে পারো। ওঁর বক্তব্য হল, তুমি একটা লিনিয়ার ইকুয়েশানের মধ্যে তো রাখতে পারো না যে 'শি ইজ লাইক দিস'। সুবর্ণরেখায় সীতার মা হওয়ার মধ্যে একটা ইন্সেসচুয়াস গেমও আছে। এমনকি সীতা যখন গান গাইছে তখন বাচ্চা অভিরাম চলে যায়। এরকম আরো অনেক জায়গা পাসোলিনির ছবি বা যে কোনো গ্রেট আর্টের মতোই বিয়ন্ড এক্সপ্লানেশান। উনি আসলে আমাদের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার নিরিখে নারীকে একটা অপূর্ণতার প্রতীক হিসাবে দেখে সেটা কীভাবে সম্পূর্ণতায় নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়ে ভেবে এসেছেন। একই সময়ে আবার কোমল গান্ধারের অনসুয়ার ক্ষেত্রে তার মাদারহুডটা এতটাই এ্যাবস্ট্রাক্ট, যে চরিত্রটা কতটা রক্ত-মাংসের নারী সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়। 

কন্ট্রাডিকশান ইন ইটসেল্ফ আধুনিকতার একটা কম্পোনেন্ট। আধুনিক শিল্প কখনই ডিটারমিনিস্টিক নয়, সে প্রোবাবিলিস্টিক।

রূপক : এবার একটু ভাষা-সাহিত্যের প্রসঙ্গে আসি। বাংলা ভাষার এবং বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী দেখছেন? 

সঞ্জয় : বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ? বিদ্যাসাগরের দুশো বছর হয়ে গেল এই ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর। শুনলে অনেকে অসন্তুষ্ট হবেন, কিন্তু গত চল্লিশ বছরে যা ট্র্যাাশ লেখা হয়েছে, এত খারাপ বিগত দেড়শো বছরে হয়নি। কবিতার জায়গায় রাইমস বলা হয়েছে, বয় মিটস এ গার্ল স্টোরি, সারা পৃথিবীতে শুধু গল্প বলে এখন উপন্যাস তৈরি হয় কেবল বাংলা ভাষায়। আমি বরং বলব বাংলাদেশে গড়পড়তা অনেক ভালো গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে।

রূপক : আর ভাষা?

সঞ্জয় : বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যা করা হচ্ছে, তা হল একটা কলোনিয়াল পলিসি এবং তা জয়যুক্ত হচ্ছে। বাংলাকে একটা আঞ্চলিক সীমাবদ্ধ ভাষা হিসাবে ভাবা হচ্ছে। এইটাকে ভেঙে দিতে হবে। আমরা গত শতাব্দীর বিশের দশকে দেখেছিলাম, পদার্থবিদ্যায় মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসুরা মনে করেছিলেন বাংলা দিয়ে বিজ্ঞান বোঝা যায়। বাংলা ভাষাটা শুধু কবিতা লেখার ভাষা না। একটা ভাষার গুরুত্ব নির্ভর করে তা দিয়ে গরু কী করে বড়ো করতে হবে, অঙ্ক কী করে করা যাবে, প্রেম কী করে করা যাবে, গালাগালি কী করে দেওয়া যাবে, কবিতা কী করে লেখা যাবে ০ এরকম সবই কী করে পারা যাবে তার উপর। সমস্যাটা হল কবি-সাহিত্যিকরা যত ভাষাটাকে শুধুই সাহিত্যের ভাষা করে তুলতে চাইছেন, তত আমরা সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। ইংরাজি সবথেকে শক্তিশালী ভাষা এই কারণে যে ইংরেজিতে তুমি খিস্তি দিতে পারো ভালো করে। ইট ইজ এ ট্র্যা জেডি যে বাংলায় অতো স্ল্যাং নেই। পিপল আর টেকিং এ ভেরি কনজারভেটিভ এক্সট্রিমিস্ট পজিশান যে এটা বিধবার হেঁশেল, এই ছোঁয়াছুঁয়ি আমরা পছন্দ করি না। আমরা এটাকে বিশুদ্ধ সাহিত্য করে রাখব। আমি খুব হতাশ এই জিনিসে। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে।

বাংলাদেশে কিন্তু অনেক কাজ হচ্ছে। গালাগাল, প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। লোককথা, লোকসাহিত্য, উপভাষা এইসব নিয়ে নৃতাত্ত্বিক কাজ হচ্ছে। 

ফরাসি ভাষাটা নিঃসন্দেহে বোদলেয়ার এতে কবিতা লিখেছেন বলে বড়ো ভাষা, সঙ্গে কিন্তু বড়ো ভাষা কারণ পাসকাল, সার্ত্র, লাপলাসরা এতে কাজ করেছেন বলেও।

রূপক : আমরা বলি আজকালের জেনারেশান বাংলা বলে না, কিন্তু তাদের বাংলা বলার মতো একটা সিস্টেম দেওয়া হয়েছে কি?

সঞ্জয় : না হয়নি তো। সে বলবে কেন? তাকে বলা হচ্ছে পঁচিশে বৈশাখ বাংলা বল। সে এদিকে ইংরেজিতে অ্যাটমের স্টেবিলিটি পড়ছে, তারপর তাকে বলছ চণ্ডালিকা নাটক করে এসো, সে করবে কেন? এটাও তো মানতে হবে যে একটা সভ্যতায় সবার চণ্ডালিকা প্রয়োজন নাও হতে পারে।

রূপক : খুব দামি একটা কথা বলেছেন। এই জায়গায় আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি এবং নবারুণ ভট্টাচার্য বারংবার বলেছে বুলগাকভ পড়ো। এই পোস্টমিলেনিয়াল জেনারেশানের কাছে বুলগাকভ কতটা কনটেক্সটচুয়াল? তারা কেন পড়বে?

সঞ্জয় : কনটেক্সটচুয়াল নয়, কিন্তু তোমাকে লড়ে যেতে হবে। অন্যগুলোও করুন সঙ্গে। নাহলে নানা দিক দিয়ে পলিফোনি এবং মাল্টিলেয়ার তৈরি হবে কীভাবে? এই জায়গাটা না থাকায় আমরা যে লিনিয়ার ট্র্যাযকে এগোচ্ছি, সে ট্র্যাতকটা যে আদপে ননলিনিয়ার হওয়ার কথা সেটাই অ্যাক্সেপ্ট করছি না। বুলগাকভ এমনই একটা দেখার চোখ যা পাতাল দিয়ে হাটতে পারে।

আজকের আলোচনায় যদি কোনো কথা গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হল, এই ননলিনিয়ারিটি শুড বি আওয়ার পাসওয়ার্ড। এবং বিজ্ঞান যদি রক্তে না ঢোকে তাহলে মুক্তি নেই।

রূপক : আপনি কি সায়েন্টিফিক টেম্পাররের কথা বলছেন?

সঞ্জয় : হ্যাঁ। সায়েন্টিফিক টেম্পার। সমস্যাটা হল আমরা এখনও দেকার্তের সেই কার্টেসিয়ান লজিক এবং ২০০ বছর আগের সায়েন্টিফিক মেজাজটা বুঝচ্ছি, আমরা কিছুতেই ১৯৫০-২০২০র টেম্পারটা বুঝছি না। এবং আমাদের বোঝার কোনো চেষ্টাও নেই। বিজ্ঞান তো গ্যালিলিওতে থেমে নেই! উনি নিশ্চই বড়ো বিজ্ঞানী। কিন্তু তুমি কেন কন্টেম্পোরারি সায়েন্সকে বুঝবে না?

রূপক : পরের প্রশ্ন রবীন্দ্রমৌলবাদ। এই রবীন্দ্র ফান্ডামেনটালিজম এর জায়গায় মোক্ষম ফিলোজফিকাল আঘাত জর্জ বিশ্বাসের গান। আপনি ‘সার্ধশতবর্ষ’ বইটায় ওঁর সঙ্গে পল রবসনের একটা সিমিলি ছোটো করে টেনেছিলেন। আমাদের সবার জন্য একটু বিস্তৃত করে বলুন প্লিজ।

সঞ্জয় : সমস্যাটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে মোটামুটি ধর্মীয় কবি প্রমাণ করা হয়েছে ইউরোপে, এবং দিস ইজ বিকজ অফ দি ‘রাবিন্দ্রীকস’(হাসি)! এদের প্রচারে রবীন্দ্রনাথ মানেই ফুল-মালা-আশ্রমিক একজন কবি। দেবব্রত বিশ্বাস তাঁকে এই বদ্ধ জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে। ওঁকে রিফ্রেশ করে, রি-এনার্জাইজ করে তোমার দৈনন্দিন প্রয়োজনে তার রেটরিকটা পালটে ফেলা, এই পালটাতে গেলে নতুন করে ভাবতে হবে। দেবব্রত শব্দগুলোকে ইন্দ্রিয় সহচর করে তুলতেন। অ্যান্ড ইউ নিড নো পাসওয়ার্ড টু এন্টার দিস ডোমেইন। 

পল রবসন করেছিলেন কী, তখন ব্ল্যাকদের্প যে স্পিরিচুয়াল গান, যার উচ্চারণ মেলানকালির, তাকে তিনি মেইনস্ট্রিম আমেরিকান ইংরেজিতে নিয়ে এসেছিলেন। উনি দেখাতে চেয়েছেন যে একটা নেশান তার নিজের অপ্রেশান, বিষাদ এই গানগুলোর মধ্যে দিয়ে বলতে পারে। জায়গাটাকে স্পর্শযোগ্য করে তোলে।

ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের এই দ্রুত অবসানের কারণ হল ওঁকে একটা স্থির নিশ্চলতায় রেখে দেওয়া হয়েছে, ১৯৪০ সালের সময় থেকে। আমার ধারণা যাঁরা ওঁকে ব্যাখ্যা করেন তাঁরা ওঁর থেকে অনেক কম আধুনিক। রবীন্দ্রনাথ যে এত পালটেছেন নিজেকে, তার অর্থ উনি ফ্লুয়িড, স্থির নন। উনি কখনই নিজেকে শালগ্রাম-শিলা মনে করতেন না!

কাজেই পাওয়ার পলিটিক্স এনে যে রবীন্দ্রনাথকে পুজো করা, এটাই মৌলবাদ। এই জায়গাটাকে আমাদের ভেঙে দিতে হবে।

রূপক : নবারুণ ভট্টাচার্য সম্বন্ধেও এই ভয়টা থেকে যাচ্ছে না?

সঞ্জয় : হ্যাঁ। এটা তো এস্টাব্লিশমেন্টের পুরনো কায়দা। যতদিন তুমি আছো ততদিন তোমায় নাজেহাল করবে। তারপর চলে গেলেই পুজো করবে। খোপ তৈরি করে বলা, ভাই আমরা তো এ্যাক্সেপ্ট করেছি। এই যে বড়োলোকের বাচ্চারা ‘চুদুরবুদুর’’ শব্দটায় খুব আনন্দ পাচ্ছে, তারা তো নবারুণের মূল এ্যাগ্রেশানটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। 

নবারুণের কাঙাল মালসাটে বোমাটা ফেলার কথা ছিল খবরের কাগজের অফিসের ওপর। এবার যেহেতু মিডিয়া রেগে গেলে সিনেমা কিছুতেই সাকসেসফুল হবে না, এবং সিনেমা মেকারের সেই সাহস নেই, ফলে সে সেই অংশটাকেই বাদ দিয়ে দিল। 

নবারুণ ওয়ান্টেড টু ক্রিয়েট আ ডিস্কন্টেন্ট, অন দি আদার হ্যান্ড যা হয়েছে সে হল একটা প্লেজারের জায়গা। 

রূপক : আমার শেষ দুটো প্রশ্ন। প্রথমত, বাঙালি কি চলচ্চিত্র নির্মাতা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে পাবে?

সঞ্জয় : সেটা বাঙালি এবং আমি দুজনেই ঠিক করতে পারি। কিন্তু ইন বিটুইন, রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে যে কথাটা বলেছিলেন, যে এ তো শুধু স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সম্পর্ক নয়, মাঝখানে একটা বিনিয়োগের ব্যাপার আছে। কয়েক কোটি টাকা বা কয়েক লাখ টাকা আমায় কে দেবে? কাজেই আনলেস দিস ইজ রিসলভড, এটা ভীষণ ট্রিকি কোয়েশ্চেন। এটা তো আর ফ্রান্স বা আমেরিকা নয় যেখানে মুনাফা দেখলেও ‘কাউন্টার কালচার ক্যান বি সোন্ড ইন কাউন্টার’(হাসি)। এখানে তো কাউন্টার কালচার বিক্রি করা খুব মুশকিল। তাছাড়া রাইটউইং পলিটিক্স যেভাবে ঘিরে ধরেছে, ফলে এই প্রশ্নের উত্তর আমায় অসমাপ্তই রাখতে হবে…

রূপক : এখন হাতে অন্যান্য নিয়মিত লেখালেখি ছাড়া লংটার্ম কাজ কি রয়েছে?

সঞ্জয় : হ্যাঁ, ওয়ালটার বেঞ্জামিন প্যারিসে শেষের দিকে যে আর্কেড প্রোজেক্টগুলো করতে শুরু করেছিলেন, ফ্ল্যানারি, আমি সেগুলোকে কলকাতা আরবান জমানার উইথ পার্টিকুলার কন্টেক্সট লাইক জীবনান্দ দাশকে নিয়ে একটা ভাববার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের শহুরে জীবনযাপনের উপর একটা কাজ হবে বলে আমার ধারণা।

এবং হঠাৎ কলকাতায় গোয়েন্দা গল্প কেন এত জনপ্রিয় হল, সেই ক্রাইসিসের জায়গাটা আমি বোঝার চেষ্টা করছি আমার মতো করে।

আমাদের সাংস্কৃতিক আধুনিকতার একটা খোলনোলচে আমি দেখতে চাই।

রূপক : আমার শেষ প্রশ্ন। আমার, বা আমার পরের প্রজন্মের জন্য, আপনি আমাদের ৫টা বই এবং ৫টা সিনেমার নাম বলে দিন যা পড়তেই হবে এবং দেখতেই হবে।

সঞ্জয় : ব্রাদারস কারামাজভ, ইডিয়ট, হ্যামলেট, পুতুল নাচের ইতিকথা, সাতটি তারার তিমির, এবং বলাকা। ছটা বললাম। 

আর সিনেমা হচ্ছে, সুবর্ণরেখা, থ্রু দা অলিভ ট্রিজ, মর্ডার্ন টাইমস, সাইকো, পিয়ের লো ফু, সায়লেন্স এবং লা নত্তে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More