স্কুলবেলা থেকেই সিনেমার জন্য লড়াই, ‘এশিয়ান’-এ স্থান পেলেন বাঙালি পরিচালক

“যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার অর্থ, বাংলা তো বটেই পাশাপাশি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা। এটা একটা আশাতীত ব্যাপার।”

বলছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক রঞ্জন ঘোষ (Ranjan Ghosh)। প্রসঙ্গ ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ (Mahishasur Mardini)। হ্যাঁ, তাঁর পরিচালিত এই সিনেমাটিই এবার বাংলা ভাষায় নির্মিত ২০২১ সালের একমাত্র চলচ্চিত্র হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায়। 

বছর সাতেক আগের কথা। ২০১৪ সাল। ‘হৃদ মাঝারে’ ছবির মধ্যে দিয়েই পরিচালক হিসাবে অভিষেক হয়েছিল রঞ্জন ঘোষের। তবে সে ছবির চর্চা হয়েছিল সীমিত ক্ষেত্রেই। বুদ্ধিজীবী মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হলেও, সার্বিকভাবে ‘হিট’ হয়ে উঠতে পারেনি ‘হৃদমাঝারে’। না, হতাশায় ডুবে যাননি তিনি। বরং, একের পর এক ভিন্ন স্বাদ ও মেজাজের ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরেই আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের অন্যতম প্রতিনিধি রঞ্জন ঘোষ। তাঁর কথায়, “একটা বড়ো ছাদের তলায় থাকলে, দর্শকদের কাছে পৌঁছনো যায় সহজেই। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার হওয়ায় আমার কাছে তেমন কোনো হাতিয়ারই ছিল না। এই ব্যাপারটা আমার মধ্যে একটা জেদের সঞ্চার করে।”


আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ২

অবশ্য ‘হৃদমাঝারে’-র আগে থেকেই চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। আর তারও বহু আগে থেকে শুরু হয়েছিল এই স্বপ্নজয়ের লড়াই। তখন বড়ো-জোর অষ্ঠম কিংবা নবম শ্রেণি। চলচ্চিত্র দেখাই শুধু নেশা ছিল না, সেই সঙ্গে ক্যামেরার পিছনে থেকে ছবি বানানোর স্বপ্ন বুনতেন তরুণ বাঙালি পরিচালক। যদিও সে-সময় সেই স্বপ্নের চারা রোপণের সুযোগ আসেনি হাতে। আর পাঁচটা প্রথম সারির মধ্যবিত্ত বাঙালি শিক্ষার্থীর মতোই তাঁকে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পথে। এসআরএফটিআই-এর বদলে তাঁর গন্তব্য হয়ে ওঠে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগ। সেখান থেকেই স্নাতক ডিগ্রি-লাভ। 

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্র উৎসব চিন্তা- ১

আর স্বপ্ন? না, তাকে তো মিথ্যে হতে দেওয়া যায় না কখনোই। স্নাতকতার পর, কয়েক বছর মার্চেন্ট নেভির চাকরি জীবন। তারপর সামান্য পুঁজি নিয়েই ফিরে আসা চলচ্চিত্রের জগতে। প্রথাগতভাবে পড়াশোনা শুরু ফিল্ম স্কুলে। সে-সময় অ্যাকাডেমিক সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অপর্ণা সেনের। ‘অন্তহীন’-এর সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসাবে জুড়ে যাওয়াও সেই সূত্রে। “অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হলেও, অন্তহীন চলচ্চিত্রে খুব কিছু কনট্রিবিউট করতে পারিনি আমি। বলতে গেলে সে ছবির পর্যবেক্ষক ছিলাম। তখন কাজ শিখছিলাম। ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবিতে অপর্ণা সেনের কাছ থেকে সব শিখেছি আমি, বলা যায়”, জানালেন বাঙালি পরিচালক। এই ছবির যুগ্ম কাহিনী এবং চিত্রনাট্যকারও ছিলেন তিনি।  

আরও পড়ুন
শুধু ‘মন্দার’-ই নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে একাধিকবার ছায়া ফেলেছে ম্যাকবেথ


তবে প্রথম চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ব্যর্থতার পরেও, বিগত সাত বছরে দর্শকদের একের পর এক পরীক্ষামূলক ও রুচিশীল চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন রঞ্জন। তাঁর কাছ থেকে ‘রংবেরঙের কড়ি’ কিংবা ‘আহা রে’-র মতো সিনেমা পেয়েছে বাংলার চলচ্চিত্রমহল। ‘আহা রে’-ও জায়গা করে নিয়েছিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এশিয়ার সেরা ফুড মুভির তালিকায় ঝলমল করেছিল এ-ছবির নাম। তবে সার্বিকভাবে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন বাঙালি দর্শক ও সমালোচকমহল। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই হয়তো তার একটা কারণ। স্বতন্ত্র পরিচালকদের জায়গা কি সংকীর্ণ হয়ে আসছে দর্শকদের কাছে? “কোনো কাজ হাইলাইট করার দায়িত্ব শুধু ছবির পরিচালক কিংবা অন্যান্য কলাকুশলীদের নয়। সেখানে দর্শক, সমালোচক এবং মিডিয়া— সকলেরই আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে। যাঁরা আলাদাভাবে ভালো কাজ করছেন, তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসাটা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব”, কোথাও যেন আক্ষেপের সুর বাজছিল তরুণ পরিচালকের গলায়। জেদেরও। সেই জেদের জোরেই আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। 


‘আহা রে’ কিংবা ‘হৃদ মাঝারে’-র মতোই ‘মহিষাসুর মর্দিনী’-র মধ্যেও চলচ্চিত্রের চেনা ছক ভেঙেছেন রঞ্জন। প্রথাগত ছবির গল্পের বুনন থেকে অনেকটাই দূরে ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। বলতে গেলে চলচ্চিত্রটিতে ধরা পড়েছে একটি মাত্র রাতের ঘটনা প্রবাহ। “কখনো সন্তান, কখনো ভগিনী, কখনো স্ত্রী, প্রেমিকা কিংবা মা— ভ্রুণাবস্থা থেকে শুরু করে আজীবন একজন নারীকে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই গোটা যাত্রাপথেই তাঁকে নানান নিষ্ঠুরতা, বিড়ম্বনা, অবহেলার সম্মুখীন হতে হয়। ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ সমাজের এই খণ্ডচিত্রগুলিরই একটি মনতাজ”, জানালেন রঞ্জন। 

শুধুই কি রঞ্জন? বাংলা চলচ্চিত্রজগতে পরীক্ষামূলক ভালো কাজ যে থেমে নেই— রঞ্জন-সহ একাধিক তরুণ পরিচালকের ‘বিদেশযাত্রা’-ই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ‘জয়’ ছিনিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। এবার দেখার, বাঙালি আদর্শ দর্শকের ভূমিকায় আদৌ সফল হতে পারে কিনা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More