বিয়ের পরেই চাকরি থেকে ইস্তফা, শর্ত দেওয়া হয়েছিল দেশের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রদূতকেও

১৯৪৯ সাল। মাত্র দুই বছর আগেই ভারত স্বাধীন হয়েছে। নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট রাত ১২টায় ঘুমে ডুবে যাওয়া পৃথিবীর ভেতর যেভাবে স্বাধীনতার আলোয় জন্ম হল একটি দেশের, তার মনে আশা তো তৈরি হবেই। প্রশাসনিক নকশা থেকে সমাজের সব স্তরেই নতুন কাঠামো তৈরি হতে লাগল। সমাজের সব স্তরেই কি? তা হয়তো নয়। ২০২০-তে দাঁড়িয়েও ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও কন্যাভ্রূণ হত্যা নিজের নিজের ভয়াল রূপ নিয়ে টিকে আছে। আইনের শাসন, বা আধুনিকতা কি সম্পূর্ণ বদল আনতে পেরেছে? তাহলে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে অবস্থাটা ঠিক কীরকম ছিল, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। এমনই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই সামনে এসেছিলেন কর্ণাটকের চোনিরা বেলিয়াপ্পা মুথাম্মা। তাঁর লড়াইই তাঁকে ইতিহাসের মঞ্চে স্থান দিয়েছে। কালে কালে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের অন্যতম ‘প্রথমা’…

ছোটো থেকেই বাবাকে দেখেছেন বনে-জঙ্গলে ছুটে যেতে। ফরেস্ট অফিসার বলে কথা, মস্ত বড়ো দায়িত্ব তাঁর। ছোট্ট মুথাম্মাও অবাক হয়ে দেখতেন তাঁকে। হঠাৎই সব কালো হয়ে গেল। মাত্র নয় বছর বয়স তখন সি বি মুথাম্মার। চিরকালের মতো চলে গেলেন বাবা। যেন ঝড় নেমে এল সংসারে। শুরু হল মা আর মেয়ের লড়াই ‘একার’ লড়াই। সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠাই মুথাম্মার ভেতর আলাদা জোর তৈরি করল। পড়াশোনায় মনোযোগী তো ছিলেনই। চেন্নাইয়ের ওম্যান ক্রিশ্চান কলেজ থেকে তিনটি সোনার পদকও পান। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করার পরই ঠিক করলেন, এবার একটা কিছু করতে হবে। সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। এবার ভারতের জন্যই কিছু করতে চান মুথাম্মা। চোখের সামনেই বাবাকে দেখেছেন ফরেস্ট অফিসারের দায়িত্বে। ঠিক করলেন, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন। লড়াই কঠিন, পড়াশোনাও কঠিন; কিন্তু চেষ্টা করলে কি না করা যায়… 

তখনও ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কোনো মহিলা পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হননি। এসব কঠিন কাজ; বিশেষ করে আইএফএস পাশ করার পর যে কাজে নিয়োগ করা হয়, সেসব মেয়েরা কেমন করে পারবে? সি বি মুথাম্মা এসব কিছু মনেই করলেন না। তিনিও একজন পরীক্ষার্থী, কৃতকার্য হওয়ার পর দেশের সেবাই করবেন। কেন ভয় পাবেন তিনি? বসলেন পরীক্ষায়। সালটা ১৯৪৮। ফলাফল বেরনোর পর দেখা গেল, ইতিহাস তৈরি হয়েছে! পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন সি বি মুথাম্মা। এর আগে কোনো মেয়েই ইউপিএসসি’র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। সামনে তিনটে রাস্তা— আইএএস, আইপিএস অথবা আইএফএস। যখন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হলেন তিনি, তখন সামনে বসে থাকা অফিসাররা রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন। কারণ, প্রথম পছন্দ হিসেবে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস বা আইএফএস-কেই বেছেছেন মুথাম্মা…

একজন মেয়ে হয়ে এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটবেন? এ যে অনেক ঝক্কির কাজ! ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা বারবার বোঝাতে লাগলেন মুথাম্মাকে। উল্টোদিকে, তিনিও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি কাজ করেন, তাহলে এখানেই করবেন। আর তিনি আইএফএসদের তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেছেন। কাজেই তাঁর দক্ষতা নিয়ে তো প্রশ্ন থাকা উচিত না! তা সত্ত্বেও কম নম্বর দিয়ে ফরেন সার্ভিস থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অন্য অফিসাররা। কিন্তু যিনি লড়াই করে এতদূর এসেছেন, তিনি হার মানবেন কেন এত সহজে! ১৯৪৯ সালে দেশের প্রথম মহিলা আইএফএস অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন সি বি মুথাম্মা। এইভাবেই শুরু হয় ইতিহাস। অবশ্য তাঁর এমন উত্থান অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। চাকরিতে ঢোকার সময়ই একটি চুক্তিতে সই করিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে। যার মূল বক্তব্য ছিল, বিয়ে হয়ে যাবার পর এই চাকরি থেকে তাঁকে ইস্তফা নিতে হবে… 

এ তো সংবিধানের অপব্যবহার। একজন নারী বলে তাঁর প্রতি এরকম ব্যবহার করা হচ্ছে! সমাজের রূপটা নিজের কাজের পরিবেশেও দেখতে পেয়েছিলেন মুথাম্মা। যখন প্যারিসে ভারতীয় দূতাবাসে গেলেন, তখনও দেখলেন একই চিত্র। স্বাধীন দেশ, তার অনেক স্বপ্ন। কিন্তু দুঃখজনক হল, সেখানে মহিলাদের কোনো জায়গা নেই। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা— তিন মহাদেশের বহু দেশেই কর্মসূত্রে গেছেন তিনি। এবং সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছেন লিঙ্গ সাম্যের কথা। কেন সব কাজে মেয়েদেরকে অবহেলা করা হবে? তাঁদের কাজ কি কেবল সংসারধর্ম পালন, রান্না করা আর সন্তান প্রতিপালন? এর বাইরে বেরিয়ে কেন দেখা হয় না মহিলাদের? সারাজীবন ন্যায়ভাবে কাজ করেছেন, সৎ থেকেছেন। অথচ কাজের জায়গায় পদোন্নতিই হয়নি তাঁর। এটা কি একজন নারীর কাজের প্রতি অসম্মান করা হচ্ছে না? সুপ্রিম কোর্টে মামলাও দায়ের করেছিলেম সি ভি মুথাম্মা। ভারতের দিকে নয়, ভারত রাষ্ট্রের মানসিকতাকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি; কাঠগড়ায় নিয়ে এসেছিলেন। 

জবাবে কী শুনতে হয়েছিল? বিদেশ মন্ত্রক একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদে যদি একজন মহিলাকে বসানো হয়, তবে কনফিডেন্সিয়াল খবর ‘বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার’ সম্ভাবনা থাকে। লিঙ্গভেদ সমাজে নয়, পৌঁছে গেছে খোদ উপরমহলেই! অবাক হয়েছিলেন মুথাম্মা; কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। নিজের সম্মান, একজন নারীর সম্মান আদায় করে তবে থেমেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পদোন্নতি হয় তাঁর। হাঙ্গেরিতে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয় সি বি মুথাম্মা-কে। এই প্রথম কোনো ভারতীয় নারী দেশের রাষ্ট্রদূত হলেন। তৈরি হল আরও একটি ইতিহাস… 

আরও পড়ুন
মহিলাদের ফুটবল দল থেকে নির্বাচনের ময়দান, জাতিভেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিমা কুমারী

অবসরের পর সামাজিক কাজকর্মেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। মুথাম্মার লক্ষ্য ছিল একটাই, যে লড়াই করে তিনি উঠে এসেছেন, যে বাধা প্রতিনিয়ত তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে; সেই অসম্মান যেন আর কোনো নারীর না হয়। এই ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা? তা তো নয়! সবাই মিলে একসঙ্গে, কাজের মধ্যে দিয়ে জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পাবে ভারত— এমনই তো কথা ছিল। আজ, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর কী মনে হয় আপনার? সি বি মুথাম্মার স্বপ্ন, উদ্যোগ কি সফল হয়েছে? আপনার চারিদিকে যে ছবি দেখতে পান, কাগজে বা টেলিভিশনে যে খবর দেখতে পান, তাতে কি এমনই প্রতিচ্ছবি উঠে আসে? বিচার করা ভার আমাদের ওপরই। সি বি মুথাম্মা’র লড়াই মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না… 

তথ্যসূত্র- ‘The untold story of C.B.Muthamma, India’s first Woman IFS Officer and Ambassador’, Sanchari Pal, The Better India 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা কমব্যাট ট্রেনার সীমা, হাত পাকিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও

More From Author See More