লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন্, এই কথার সত্যতা যাচাই করতে পদার্থবিজ্ঞানের চেয়ে ভালো উপায় নেই বললেই চলে। আমাদের গ্রে ম্যাটারের আওতার বাইরে যে বিশাল দুনিয়া তার কতটুকুই বা আমরা জেনে উঠতে পেরেছি! আর অজানাকে জানার-অদেখাকে দেখার এই তাড়নাই যুগে-যুগে কিছু মানুষকে প্রেরণা জুগিয়ে গেছে। সেরকমই একজন পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান।
জন্ম ১৯১৮ সালের ১১ মে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। মা লুসিল যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখনই বাবা মেলভিল ঘোষণা করেন, লুসিল যদি পুত্রসন্তান প্রসব করেন, তাহলে সে হবে বিজ্ঞানী। রিচার্ড অল্প বড়ো হতে তিনি তাঁকে একটি স্কুলে ভর্তি করালেন বটে, তবে বাড়িতে বাবার অধীনেই চলতে থাকল ছেলের বিজ্ঞানচর্চার প্রাথমিক পাঠ। মাঝেমাঝেই বিকালে বাবার সঙ্গে কাছেপিঠে হাঁটতে যেতেন ছোট্ট রিচার্ড, এবং সেইসময়ে চারপাশে থাকা নানা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তিনি তাঁকে বুঝিয়ে দিতেন বিজ্ঞানের গুঢ় সব তত্ত্ব, শেখাতেন কীভাবে সামনের আপাত আস্তরণকে সরিয়ে খুঁজে নিতে হয় প্রকৃত সত্যকে।
এই সমস্ত শিক্ষাকে পাথেয় করেই ভবিষ্যতে ফাইনম্যান হয়ে ওঠেন বিজ্ঞান জগতের অবিসংবাদী কিংবদন্তি। ১৯৬৫ সালে কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স বা কিউ ই ডি নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণার জন্য ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পান, যা আলোর সঙ্গে পদার্থকণা ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার বিষয়ে বর্ণনা করে। অনেকের মতে একটি নয়, তাঁর সমগ্র রিসার্চের জন্য ফাইনম্যান তিন-তিনটে নোবেল পেতে পারতেন। তবে তাঁর গবেষণা নয়, আমরা বরং চোখ রাখব মহান এই বিজ্ঞানসাধকের জীবনের তুলনামূলক অনালোচিত একটি অধ্যায়ে।
রিচার্ড যখন হাইস্কুলে, একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে কাছেই রকঅ্যাওয়ে সৈকতে ঘুরতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় আরলিন গ্রিনবামের। শুধুই আলাপ, একেবারে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে, আরলিনকে তাঁর এতই ভালো লেগে যায় যে তিনি তখনই মনঃস্থির করেন বাকি জীবন এঁর সঙ্গেই কাটাবেন। এমনকি কিছুটা বেশি সময় কাটানো যাবে ভেবে ফাইনম্যান মেয়েটির সঙ্গেই এক আর্ট স্কুলেও ভর্তি হয়ে যান। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আরলিনকে প্রেম নিবেদন করেন, আর বলাবাহুল্য আরলিনও তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
তবে কিছু বছর পরেই আরলিনের শরীরে অদ্ভুত এক রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে টাইফয়েড বলেই অনুমান করেন। তবে যেমন রহস্যজনকভাবে তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন সেভাবেই দেখা যায় আরলিন সেরেও উঠছেন। কিন্তু পরিষ্কারভাবে কিছু বলতে না পারলেও ডাক্তাররা বুঝছিলেন আরলিন হয়তো কোনো মারণ রোগের শিকার। ফার্মিংডেল হসপিটালে যখন ফাইনম্যান আরলিনকে রোজ দেখতে যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন একটি চিঠি – ‘গুডবাই লাভ লেটার’। নিজমুখে বলতে না পারলেও ভেবেছিলেন চিঠি লিখে শারীরিক অসুস্থতার ব্যাপারে তাঁকে জানাবেন। তবে সত্যিটা জানতে আরলিনকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বাড়িতে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনম্যানের সঙ্গে যখন তাঁর সাক্ষাত হয়, তিনি আরলিনকে চিঠিটা দিয়ে সব কথা খুলে বলেন, এবং ওইমুহূর্তেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
এরমধ্যেই ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা যায় আরলিন যক্ষ্মার শিকার। সালটা ১৯৪১, পেনিসিলিনের প্রথম সফল প্রয়োগ হতে তখনও একবছর বাকি। ফলতঃ যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিস হওয়া মানে রোগীর মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত। বছর বাইশের রিচার্ড যখন বাড়িতে তাদের বিয়ের কথা বললেন, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি করলেন, কারণ অত সম্ভাবনাময় কেরিয়ার ছেড়ে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত একটি মেয়েকে বিয়ে করা মানে যেচে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। তবে শেষে সকলের আপত্তি খণ্ডন করে, ফাইনম্যান যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, করুণার মনোভাব থেকে নয়, অসুস্থ প্রেমিকার যত্ন নেওয়ার জন্যই তিনি দ্রুত বিয়ে করতে চান আরলিনকে। পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে ২৯ জুন, ১৯৪২, স্টেটেন আইল্যান্ডে আরলিনকে বিয়ে করলেন ফাইনম্যান।
আরও পড়ুন
শুধুই পদার্থবিদ্যা নয়, বাংলার নদী-নালা নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছিলেন মেঘনাদ সাহা
ইতিমধ্যে পার্ল হারবার আক্রমণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি যোগ দিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। দেশের অন্যতম প্রতিশ্রুতিবান পদার্থবিজ্ঞানী হিসাবে ফাইনম্যানকে নিযুক্ত করা হল অ্যাটম বোমা তৈরির ম্যানহাটান প্রজেক্টে। কাছেই আলবাকার্কি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন আরলিন। উইকএন্ডে ফাইনম্যান ছোটেন আলবাকার্কিতে আরলিনের সঙ্গে দেখা করতে, নিয়তি নিশ্চিত জেনেও সবসময় তাঁকে সাহস জোগান। স্ত্রীকে লেখা প্রতিটা চিঠিতে তিনি লিখতেন তাঁকে তিনি কতটা ভালোবাসেন এবং আজীবন ভালোবেসে যাবেন। তাদের বিয়ের প্রায় আড়াই বছর পর, আরলিনের শারীরিক অবস্থার ক্রমে অবনতি হতে থাকে, তাঁর ওজন অনেক কমে যায় অনেক এবং ডাক্তাররাও তাদের অসহায়তার কথা জানিয়ে দেন।
১৯৪৫ সালের ১৬-ই জুন, লস আলামোসের কম্পিউটিং রুমে কাজ করছেন ফাইনম্যান, হাসপাতাল থেকে খবর এল, আরলিন মৃত্যুশয্যায়। এক সহকর্মীর গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে সেখানে পৌঁছে দেখলেন আরলিন শান্তভাবে শুয়ে আছেন, তাঁর নড়াচড়া প্রায় বুঝতে পারছেন না বললেই চলে। পদার্থবিজ্ঞানের সুত্রে সময়ের গুরুত্ব তিনি এতদিন যথেষ্টই জেনে এসেছেন, তবে নিজের একসময়ের প্রেমিকা এবং বর্তমান স্ত্রীর মৃত্যুশয্যার পাশে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার সময় নিজেকে তথা বিজ্ঞানের এতশত অগ্রগতিকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল তাঁর। শেষে সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে সেদিন রাত ৯-টা নাগাদ ফাইনম্যান পাশে থাকা অবস্থায় আরলিন গ্রিনবাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার অকালমৃত্যুর এই শোক তিনি সারাজীবনে ভোলেননি। তবে সবচেয়ে সাড়াজাগানো ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৮ সালে ফাইনম্যানেরও মৃত্যুর কয়েকমাস পর। তাঁর জীবনীকার জেমস গ্লাইক পুরানো নোটবুক এবং চিঠিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ড্রয়ারে যা পান তাতে তিনি যারপরনাই অবাক হয়ে যান। গ্লাইকের নিজের কথায়, ‘জীবনীকার হিসাবে এরকম একটি চিঠির সাক্ষী আমি কখনোই হইনি’। যে চিঠিটি তিনি পান সেটি ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে লেখা, এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক তা আরলিনকে উদ্দেশ্য করে লেখা, তাঁর মৃত্যুর ৪৮৮ দিন বা প্রায় দেড় বছর পরে। চিঠিটিতে ফাইনম্যান লিখছেন,
আরও পড়ুন
নতুন শক্তির জন্ম, পদার্থবিদ্যার যুগান্তকারী আবিষ্কারে বদলে যেতে পারে বহু ধারণাই
“প্রিয় আরলিন,
আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয়তমা।
এটা শুনতে তুমি কতটা পছন্দ করো তা আমি জানি - তবে শুধুমাত্র তোমার শুনতে ভালো লাগে সেই কারণেই আমি লিখি না - আমি লিখি কারণ তোমায় একথা বলতে গিয়ে আমার অন্তরও বারংবার উষ্ণতায় ভরে ওঠে। তোমাকে শেষ চিঠি লিখেছিলাম অনেক দিন হয়ে গেল – তবে আমাকে তুমি নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে কারণ তুমি তো জানোই আমি কতটা জেদি আর বাস্তববাদী।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের বাতিল যন্ত্রাংশ দিয়ে গবেষণা, বাঙালি পেয়েছিল পদার্থবিদ্যায় প্রথম মহিলা ডক্টরেটকে
কিন্তু প্রিয়তমা, আমি জানি যা করতে এতদিন দেরি করেছি তা এখন করে ফেলাই শ্রেয়। আমি তোমাকে বলতে চাই, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমি তোমায় ভালবাসতে চাই এবং আমি তোমাকেই চিরকাল ভালোবেসে যাব। তুমি মারা যাওয়ার পরে তোমাকে ভালোবাসার মানে কী তা আমি জানি না – তবে আমি এখনও তোমাকে স্বস্তি দিতে চাই আর তোমার যত্ন নিতে চাই – এবং আমি চাই যে তুমিও আমাকে ভালোবাসো আর যত্ন নাও। আমার সমস্যাগুলোর কথা তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই – আমার ছোটখাটো ভাবনাগুলো তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
এইসময়ে তুমি হয়তো আমাকে কিছুই দিতে পারবে না তবুও আমি তোমাকে ভালোবেসে চলেছি যাতে অন্য কাউকে ভালোবাসার পথে তুমি বাধা হয়ে দাঁড়াও। আমি চাই তুমি এভাবেই থাকো। হয়তো তুমি মৃত, তবে জীবিত সব মানুষদের চেয়ে তুমি অ-নে-ক ভালো।
তুমি শুনে অবাক হবে, দু’বছর পরেও আমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই (অবশ্যই তোমাকে ছাড়া, প্রিয়তমা)। এক্ষেত্রে তুমিও কিছু করতে পারবে না, আর আমিও পারব না - আমি জানি না কেন! এরমাঝে অনেক মেয়েদের সঙ্গেই আমি দেখা করেছি – তবে দু-তিনবার সাক্ষাতের পর তাদের সবাইকেই খুবই অনাকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কেবল তুমিই থেকে গেছ আমার কাছে বাস্তবতা হয়ে।
আমার প্রিয় স্ত্রী, আমি তোমায় ভালোবাসি।
আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি। আমার স্ত্রী মৃত।”
এরকম একটি হৃদয়-বিদারক চিঠির শেষে বাদ যায়নি ফাইনম্যানের সহজাত হিউমারও, পুনশ্চ লিখে যোগ করেছেন “চিঠিটা তোমায় না পাঠানোর জন্য ক্ষমা কোরো — কারণ তোমার নতুন ঠিকানা যে আমি জানি না।”
নিঃসন্দেহে গোটা পৃথিবীর কাছে ফাইনম্যান পরিচিত বিশাল মাপের একজন বিজ্ঞানী হিসাবে, তবে সেই ব্যাপক ঔজ্জ্বল্যের নিচে চাপা পড়ে গেছে ওঁর মহান প্রেমিকসত্তা। তিনি সেই তরুণ যে প্রেমিকার মারনব্যাধি সত্বেও তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিল যাতে কেবলমাত্র কিছুবছর একসঙ্গে কাটানো যায়। তিনি সেই তরুণ যুবকটি যে প্রতি সপ্তাহান্তে নিউ মেক্সিকোর জনমানবহীন স্টপেজ থেকে বাস ধরত অন্য শহরের হসপিটালে থাকা প্রেমিকার সঙ্গে একটিবারের জন্য দেখা করার আশায়। তিনি সেই তরুণ যে নিজের ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যুযন্ত্রণা বুকে নিয়েও পরেরদিনই আবার কম্পিউটেশন টিমে যোগ দিতে পারেন, কারোর সমবেদনার তোয়াক্কা না করেই। আবার তিনিই সেই তরুণ প্রেমিক যিনি কয়েকমাস পর এক দোকানের শোকেসের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারেন সাদা একটি গাউন দেখে, যা তিনি একদিন আরলিনকে কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
আজ এই চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে, চারিদিকে যখন শুধুই ঘৃণা আর হিংসার ছবি, সবার নখদাঁত লকলক করছে অতলান্তিক লোভ আর লাভের আশায়, সেখানে কি অন্য একটা পৃথিবীর স্বপ্ন আমরা দেখতে পারিনা! আমরাই তো পারি আগামীদিনে ভালোবাসা, চুমু, আদর আর ভরসার সংক্রমন করে তুলতে। আমরা বরং প্রেমে পড়ি - প্রেমে মরি। আর এই দুর্দিনে বারবার করে মনে করি রিচার্ড ফিলিপ ফাইনম্যানকে, সেই মানুষটি, যিনি অবলীলায় বলতে পারতেন – “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পদার্থবিদ্যা নয়, জগতের কোনো জ্ঞানতত্ত্বই নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভালোবাসা।”
Powered by Froala Editor