দেশের প্রাচীনতম ধারাবাহিক সংবাদপত্র, ২০০ বছর পূর্তি ‘বোম্বে সমাচার’-এর

উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিক। মারাঠাদের সঙ্গে সেসময় নিত্যদিনের সংঘাত লেগে রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তবে খুব বেশিদিন ঔপনিবেশিক শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না মারাঠা সম্রাট। ১৮১৭ সালে কিরকি’র যুদ্ধের পরই দক্ষিণের ক্ষমতা দখল করে ব্রিটিশরা। আর তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই চেহারা বদলে গেল সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলটার। হয়ে উঠল অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সমুদ্রপথে জাহাজের মাধ্যমে চলত তুলো আর পোশাকের আমদানি-রপ্তানি। আর সেই ট্রেডিং-এর অর্থেই ধীরে ধীরে ফুলে ফেঁপে উঠল ব্রিটিশ শাসকরা। বাদ গেলেন না স্থানীয় বাসিন্দারাও।

তবে শুধু পণ্য-অর্থ বিনিময়ের ওপরেই তো আর বাণিজ্য নির্ভর করে না। একইভাবে গোটা বাজারের সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট ধারণাও তো থাকা দরকার বাণিজ্যিকদের। সেই কথা ভেবেই পার্সি পণ্ডিত তথা বিনিয়োগপতি ফারদুনজি মারজানের হাত ধরে মহারাষ্ট্রের বুকে ১৮২২ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল বাণিজ্য ভিত্তিক সংবাদপত্র ‘বোম্বে সমাচার’। তারপর মুম্বাইয়ের ওপর দিয়ে পেরিয়ে গেছে বহু ঝড়ঝঞ্ঝা। দু’-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, এমনকি দুটি মহামারীও দাপট দেখিয়েছে বাণিজ্যনগরীতে। কিন্তু থেমে যায়নি পথ চলা। ধারাবাহিকভাবেই প্রকাশিত হয়ে এসেছে ‘বোম্বে সমাচার’। যদিও নাম পাল্টে এখন সে ‘মুম্বাই সমাচার’। গত ১ জুলাই-ই এবার ২০০ বছর সম্পূর্ণ করল এই ঐতিহাসিক সংবাদপত্র।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ভারতের প্রাচীনতম সংবাদ পত্রিকা এটিই। পাশাপাশি বিশ্বের তালিকায় এটি রয়েছে চতুর্থ স্থানে। অবশ্য ভারতের স্থানীয় ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র বাংলার ‘সমাচার দর্পণ’। তার আরও চার বছর পর শুরু হয়েছিল ‘বোম্বে সমাচার’-এর পথ চলা। তবে ‘সমাচার দর্পণ’ বহু যুগ আগে বন্ধ হয়ে গেলেও, আজও নিয়ম মেনেই প্রকাশ পায় ‘মুম্বাই সমাচার’। 

একেবারে শুরুর দিকে সাপ্তাহিক পত্রিকা থাকলেও, বর্তমানে দৈনিক পত্রিকার আকারেই প্রকাশ পায় ‘বোম্বে সমাচার’। বর্তমানে গোটা মুম্বাই জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই সংবাদপত্রের বেশ কয়েকটি অফিস। শুধু এই পত্রিকাই নয়, বরং পত্রিকার প্রাচীন অফিসগুলিও শহরের ঐতিহ্যের প্রতীক। গুজরাটি এবং ইংরাজি দুটি ভাষাতেই বর্তমানে প্রকাশিত হয় এই পত্রিকা। তবে মূলত বাণিজ্যকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে এই পত্রিকার পাঠক পরিধি খানিকটা সীমাবদ্ধই। সবমিলিয়ে গুজরাট ও মহারাষ্ট্র জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ‘মুম্বাই সমাচার’-এর দেড় লক্ষ পাঠক। 

আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে ‘লেখক ব্যাঙ্ক’, তিন দশক আগে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত

তবে পাঠকের সংখ্যা দিয়ে পত্রিকার মান বিচার করা খানিকটা মূর্খতাই হবে। কারণ, ভারতের অন্যতম দামি পত্রিকাগুলির মধ্যে একটি ‘মুম্বাই সমাচার’। দৈনিক সংখ্যার দাম ১০ টাকা। আর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ছাপা পত্রিকাগুলির মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রথম সারিতেই রয়েছে এটি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে এই পত্রিকার পথচলা। দামের পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণেও ধাক্কা খেয়েছে পত্রিকার ব্যবসা। আদতে অরাজনৈতিক হলেও কেন্দ্রীয় সরকার সমালোচনা করতে পিছপা হয় না ‘মুম্বাই সমাচার’। সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানেই। পাঠকদের একটা বড়ো অংশ গুজরাটি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থক হওয়ার কারণে বেশ খানিকটা কমেছে জনপ্রিয়তা। তার ওপরে মহামারীর প্রকোপ যেন আরও একটা বড়ো ধাক্কা।

আরও পড়ুন
ছুটির দিনে কফি হাউসে বসেই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কিন্তু এত প্রতিকূলতার মাঝেও ক্রমশ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ২০০ বছরের প্রাচীন সংবাদপত্রটি। লকডাউনে পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে, পত্রিকার দাম ২ টাকা বৃদ্ধি করেই কোনো ক্রমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান মালিক কামা। কিন্তু কর্মীছাঁটাই-এর পথে হাঁটেননি তিনি। পাশাপাশি নজর রাখা হয়েছে পত্রিকার মানেও। বিজ্ঞাপনের সংখ্যা বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির সুযোগ থাকলেও, তা গ্রহণ করেননি কামা। 

আরও পড়ুন
টাইম পত্রিকার ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ জন’-এর তালিকায় শাহিনবাগের দাদি

দ্বিশতবর্ষে পদার্পণের কথা ভেবে গত বছর থেকেই বেশ কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন নতুন আঙ্গিকে শুরু করবেন পত্রিকার প্রচার। তবে মহামারীর কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি কিছুই। টানাপোড়েন চলছে অর্থনীতি নিয়েও। তবু হার মানতে নারাজ দেশের প্রাচীনতম ধারাবাহিক সংবাদপত্রের কর্ণধার। আর কর্মীদের উপার্জনের পথ সচল রাখতেও বদ্ধপরিকর তিনি। এই অসম লড়াইয়ের শেষ পরিণতি ঠিক কী, তার উত্তর দেবে সময়ই… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More