বইমেলার একমুঠো অক্সিজেন - সাম্প্রতিক ছ'টি লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা

'ছোট ছোট পায়ে স্বপ্ন দেখায় লিটল ম্যাগাজিন'। কয়েক বছর আগে কলকাতা বইমেলার আবহ সঙ্গীতের এই লাইনটি আজও অনেকের মনে আসে। যত মেলা এগোয়, জমজমাট হয়ে ওঠে প্যাভিলিয়ন চত্বর। তরুণ কবির স্পর্ধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠে আসে অনেক পত্রিকাও। তেমনই কিছু পত্রিকার ছোট্ট আলোচনা থাকছে আপনাদের জন্য। সেরকমই ছ'টি পত্রিকার কথা, এই পর্বে -

তবুও প্রয়াস (গোপাল ভাঁড় সংখ্যা)

গোপাল ভাঁড় বলে কি সত্যিই কেউ ছিলেন? না নিছক একটি মিথ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বাঙালি, শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। কোনো কোনো গবেষক বলেন, গোপাল ভাঁড় নাকি একটি কাল্পনিক চরিত্র। আবার, অনেকের মতে, সত্যিই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাসদ ছিলেন গোপাল। এমনই নানা সম্ভাবনা, সত্যতা ও গোপাল ভাঁড় সম্পর্কিত আরও বিভিন্ন লেখা নিয়ে সেজে উঠেছে তবুও প্রয়াসের ‘গোপাল ভাঁড় সংখ্যা’, সেলিম মণ্ডলের সম্পাদনায়।

শুধু গোপালের অস্তিত্বের খোঁজই নয়, তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষিতে গোপালের ভূমিকা, গোপালের বিদূষক চরিত্র, চলচ্চিত্রে গোপাল ভাঁড় – ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে পত্রিকাটিতে। রয়েছে গোপালের তথাকথিত বংশধর নগেন্দ্র দাসের সঙ্গে কথোপকথন এবং বিভিন্ন পুরনো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত গোপাল সম্পর্কে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনাও।

এ-পত্রিকার আরেকটি আকর্ষণীয় অংশ হল নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা ‘নবদ্বীপ-কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ বইটির ফ্যাকসিমিলি। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত এই বইটি বর্তমানে দুর্লভ। বইটির লেখক নগেন্দ্রনাথ দাস দাবি করেছিলেন, তিনি গোপাল ভাঁড়ের বংশধর। এ-নিয়ে বিতর্কও রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু গোপাল ভাঁড় সংক্রান্ত গবেষণায় প্রত্যেকেই কমবেশি উঁকি দিয়েছেন বইটিতে। বইটির সংযুক্তিকরণ অন্য মাত্রা দিয়েছে পত্রিকাটিকে।

গোপাল ভাঁড় নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই আজও। এই পত্রিকা পাঠককে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেবে কিনা, তা পাঠকই বিচার করবেন। তবে এটুকু বোধ করি বলা চলে, গোপাল ভাঁড় সংক্রান্ত এমন সার্বিক কাজ বাংলায় এর আগে তেমন হয়নি। সম্পাদক সেলিম মণ্ডল ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দীর্ঘ অধ্যাবসায় ও পরিশ্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

আঙ্গিক (সাংস্কৃতিক ক্ষয় এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংখ্যা)

“ফ্যাসিবাদ – আজকের শব্দ নয়। এই সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এটি একটি ভয়বহুল দিকনির্দেশ। যা হিংস্র করে তোলে আপামর মানুষকে।” – লিখছেন সম্পাদক। খোঁজার চেষ্টা করছেন, “এই ক্ষয় কি আমাদের বাংলা সংস্কৃতি বা সাহিত্যে পড়েনি? পড়লে কীভাবে? ইতিহাসই বা কী বলে? বর্তমান অবস্থাটি কেমন?” আর এই খোঁজেরই উত্তর হিসেবে হাজির হয়েছে আঙ্গিক পত্রিকা, তার সাম্প্রতিক ‘সাংস্কৃতিক ক্ষয় এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংখ্যা’ নিয়ে।

সুমন সাধুর সম্পাদনায়, দীর্ঘদিন ধরেই আঙ্গিক কাজ করে চলেছে নজরকাড়া বিষয় নিয়ে। ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যা’, ‘নিষিদ্ধ সংখ্যা’, ‘পাঠক সংখ্যা’র পর, সাম্প্রতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংখ্যাতেও নিজের চরিত্র বজায় রেখেছে এই লিটল ম্যাগাজিনটি। ভারতের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে, দেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা একধরণের ‘ফ্যাসিবাদ’-কে ভয়ের চোখে দেখছেন অনেকেই। ধর্ম হোক বা শাসকের আস্ফালন – বিপর্যস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষই। তার ছাপ পড়ছে সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজেও। সর্বোপরি, মানুষের মনে। সেই ‘ঘুণ’-এরই উৎস খোঁজার চেষ্টায় নিয়োজিত আঙ্গিকের এই বিশেষ সংখ্যাটি।

সন্মাত্রানন্দ, অশোকেন্দু সেনগুপ্ত, পার্থজিৎ চন্দ, সঙ্ঘমিত্রা হালদার, সোহম ভট্টাচার্য ও আরও অনেকের মনোজ্ঞ লেখা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, এই ফ্যাসিবাদ থেকে কি মুক্তি আছে আদৌ? বাহ্যিক আস্ফালন সরে গেলেও, সমাজের মধ্যেকার অন্তঃসলিলা আস্ফালনগুলোকে কি ঘোচাতে পারব আমরা? নাকি হরেক পুরুষ-নারী-তৃতীয় লিঙ্গ নির্বিশেষে হরেক ‘ফতোয়া’ নিয়েই বাঁচতে হবে আমাদের? কী অপেক্ষা করে আছে আগামী প্রজন্মের জন্য?

ইন্দ্রনীল ঘোষের প্রচ্ছদও যেন সেই চিন্তাটাকেই উস্কে দেয়। জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে, খানিক আত্মদর্শনও হয়তো হতে পারে সংখ্যাটি পড়লে। পাঠক বলতে পারবেন...

তমসা

‘লিটল ম্যাগাজিনের সেইসব সৃজনশীল স্পর্ধিত চিবুকগুলো / যাদের আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম / চিরকালীন অন্ধকারে’ – উৎসর্গের এই দীর্ঘশ্বাসই যেন চিনিয়ে দেয় লিটল ম্যাগাজিনের আবেগ ও আত্মীয়তাকে। কবিতা পত্রিকার স্পর্ধা, সাহস ও নতুন কিছু করার ইচ্ছেকে। কিংবা, এতকিছু না হয়ে, নেহাৎ তরুণ কবিদের আশ্রয় হয়ে উঠলেই বা ক্ষতি কী! সুজল সাহা সম্পাদিত তমসা তেমনই একটি পত্রিকা। সুদূর কাটোয়া থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকা তরুণদের আশ্রয় দিতে জানে। আশ্রয় দেয় ভালো কবিতাকেও। সম্পাদকীয়তেও যেন সেই কথারই অনুরণন – ‘অধিকাংশ মানুষকে বিষাদ অবসাদ পতনের থেকে উদ্ধারের ক্ষমতা একমাত্র কবিতারই আছে।’

তমসা পত্রিকার বর্ষা সংখ্যা যেন সেই সঞ্জীবনীই। একঝাঁক তরুণের কবিতা ও গুচ্ছকবিতার পাশাপাশি, শুভ চক্রবর্তীর গদ্যও এই পত্রিকার সম্পদ। রয়েছে নব্বইয়ের দশকের কবি ও কবিতা নিয়ে গৌতম সাহার একটি আলোচনাও। শুভদীপ সেনশর্মার প্রচ্ছদে, তমসা যেন তার নামের বিপরীতে আলোরই দিশারী। এই বৈপরীত্যও কি লিটল ম্যাগাজিনেরই ধর্ম নয়?

চিলেকোঠা

সিনেমা দেখতে আমরা প্রত্যেকেই ভালবাসি। এক এক জনের পছন্দ এক এক রকম। অনেকে আবার সিনেমাটির সমালোচনাও করেন। বঙ্গ সংস্কৃতিতে চলচ্চিত্র সমালোচনা একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। এবার সেই বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রকাশ পেয়েছে 'চিলেকোঠা'। চলচ্চিত্র সমালোচনা তাদের বিশেষ সংখ্যা।

মোট দশটি ভারতীয় সিনেমার রিভিউ রয়েছে এই ছোট্ট পত্রিকায়। যার মধ্যে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের 'শাখাপ্রশাখা', ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দ্য লাস্ট লিয়র'; তেমনই আছে অরিন্দম শীলের 'ধনঞ্জয়', অনীক দত্তের 'মেঘনাদ বধ রহস্য'-এর মতো এখনকার ছবি। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বোধহয় 'লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা' সিনেমাটির রিভিউ। অলঙ্কৃতা শ্রীবাস্তবের সিনেমাটি গোটা ভারতেই সাড়া ফেলেছিল। তথাকথিত 'রেটিং' ভিত্তিক রিভিউয়ে না গিয়ে, সম্পূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে ছবিগুলো নিয়ে। 'চিলেকোঠা'র সম্পাদনায় বিতান দে।

মন্থন

'বিষপাত্রের অধিকার'। এই বিষ কীসের? কবিতা? যা প্রতি মূহুর্তে তাড়িয়ে বেড়ায়, নিজেকে পোড়ায়? নাকি নিজের যাপনরত জীবন... অমৃত ভাণ্ডারের কণা চুঁইয়ে আমাদের কণ্ঠে এসে জমে এই গরল। নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় 'মন্থন' পত্রিকা এমনই যাপন থেকে উঠে এসেছে। পত্রিকার শুরুতেই রয়েছে অনন্য রায়ের কবিতা। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে আরও একবার অনন্য'র কবিতা উঠে এল। "তবুও এই বেঁচে থাকা: এই বেঁচে থাকাটুকু একমাত্র সুন্দর: সত্য;/ সাক্ষী থাকে মৃত্যু প্রহরীর!..."— কবির এই 'তবুও' কি সেই মন্থনে উত্থিত বিষের কাছেই ফিরে যাচ্ছে বারবার? এই প্রশ্ন নিয়েই পত্রিকার ভেতরে পা বাড়ায় পাঠক।

এই সংখ্যায় প্রকাশিত প্রতিটি কবিতাই সেই যাপনকে কেন্দ্র করে বেড়ে উঠেছে। কৃষ্ণ মণ্ডল, প্রসূন মজুমদার, রাজদীপ রায়, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ঔরশীষ ঘোষ প্রমুখের কবিতাই পাঠকের কাছে এক একটি স্বতন্ত্র যাত্রা। সঙ্গে রয়েছে অর্পণ বসু'র অনুবাদে ভাস্কো পোপার কবিতা এবং সৌভিক বসু'র অনুবাদে লিওনার্দ কোহেনের কবিতা। এছাড়াও শুভ্রা মুখার্জি ও অরূপ ঘোষের গদ্যও নজর টানে। পত্রিকার চমৎকার প্রচ্ছদ ও অলংকরণে নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

অন্যকথা

'পরিবেশ নিয়ে জেহাদ! বড়দের বিরুদ্ধে ছোটদের অসম লড়াই'। অসম হলেও, পরিবেশ রক্ষার এই লড়াইয়ে ছোটদের সামিল হওয়া নিঃসন্দেহে বিগত এক বছরের অন্যতম বড় ঘটনা। উঠে এসেছে গ্রেটা থানবার্গও। এই পরিবেশ আন্দোলনকে নিয়েই শুরু হয়েছে 'অন্যকথা'র শারদীয়া সংখ্যা। পত্রিকার বেশ কিছু লেখায় চলে এসেছে পরিবেশের প্রসঙ্গ।

ছোটগল্প, কবিতা, ছড়া নিয়ে সেজে উঠেছে এই সংখ্যা। নন্দিনী মুখোপাধ্যায়, দেবযানী বাগ, দৃষ্টি দে, অতুল রায় প্রমুখের কবিতা জায়গা পেয়েছে এখানে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, কাজকর্মের ফাঁকে যারা একটু আধটু কাব্যচর্চা করেন, তাঁরাই জায়গা করে নিয়েছেন 'অন্যকথা'-তে। পত্রিকার নামকরণও সেইদিক থেকে সার্থক বলাই যায়। সম্পাদনার দায়িত্বে ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায়।

More From Author See More