যুদ্ধে নিখোঁজদের সাইকেল দিয়ে মনে রাখে মেসির শহর

আর্জেন্টিনার সান্টা ফে রোজারিও (Rosario) শহরের কথা উঠলে সবার আগে কীসের কথা মনে পড়বে? ফুটবলপ্রেমী যে কোনো মানুষ একবাক্যে বলে উঠবেন লিওনেল মেসির নাম। ঠিক, তাঁর জন্মস্থান এখানেই। ফুটবল বিশ্বকাপে পিটার ড্রুরির সেই বিখ্যাত ধারাভাষ্যের পর সারা বিশ্ব চেনে এখন এই ছোট্ট শহরটিকে। কয়েক মাস আগেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল শহরের নির্জন রাস্তায় মেসির সাইকেল চালানোর ভিডিও। আর এই গল্পটাও সাইকেল নিয়েই। রোজারিও শহরটা একটু ঘুরে দেখলেই চোখে পড়বে বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে আঁকা সাইকেলের ছবি। নিশ্চয়ই কোনো আপনভোলা শিল্পীর কর্ম! এরকম ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এই ছবিগুলির সঙ্গে জড়িয়ে আর্জেন্টিনার এক কালো ইতিহাস। এক অর্থে সাইকেলগুলিকে যুদ্ধের স্মারক বললেও হয়তো ভুল বলা হয় না।

কাজটি প্রথম শুরু করেন শিল্পী ফার্নান্দো ত্রাভের্সো (Fernando Traverso)। ২০০১ সালে তিনি রোজারিও-র বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে, জানলা-দরজায়, ফাঁকা পাঁচিলে আঁকতে থাকেন সাইকেলের স্টেনসিল ছবি। প্রথম পর্যায়ে তিনি নিজে এঁকেছিলেন ২৯টি ছবি। পরে পাশে এসে দাঁড়ান আরো বহু মানুষ। মোট ৩৫০টি ছবি এঁকে শেষ হয় কাজ। ফার্নান্দো ছবি আঁকা ছাড়াও কাজ করতেন একটি হাসপাতালে। আর সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন রাজনীতিতে। যে রাজনীতি একটা সময়ে বিপদ হয়ে দেখা হয়েছিল আর্জেন্টিনার মানুষের জন্য। তার কাহিনি জানতে পিছিয়ে যেতে হবে গত শতকের সাতের দশকে। 

আর্জেন্টিনায় তখন চলছে ‘নোংরা যুদ্ধ’। বিদেশি কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, লড়াই সে দেশের স্বৈরতন্ত্রী সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের। ১৯৭৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ইসাবেল পেরনকে। ‘জুন্টা’-র নেতৃত্বে চলে অত্যাচার আর গুপ্তহত্যা। মূল লক্ষ্য বামপন্থী মনোভাবাপন্ন মানুষেরা। শোনা যায়, পুরো পরিকল্পনায় সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল আমেরিকা সরকারের। পুত্রসন্তান জন্মালেই ঘর থেকে বের করে নিয়ে হত্যা করা হত তাদের। ১৯৮৩ সালের মধ্যে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান প্রায় ত্রিশ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। আজও তাঁদের খোঁজ চালাচ্ছেন আত্মীয়রা। সান্টা ফে-র প্লাজা দে মায়োতে ‘নিখোঁজ’ মানুষদের বাড়ির মহিলারা মাথায় সাদা কাপড় জড়িয়ে উত্তর চান প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার। রোজারিও থেকেও হারিয়ে গেছিলেন সাড়ে ৩৫০ মানুষ। 

কিন্তু তাদের স্মৃতির জন্য সাইকেলকেই কেন বেছে নেওয়া হল? সাইকেল এই শহরের সবচেয়ে প্রিয় বাহন। ‘নোংরা যুদ্ধ’-এর (Dirty War) সময় রাস্তায় প্রায়ই পাওয়া যেত পরিত্যক্ত সাইকেল। যার অর্থ, অপহরণ করা হয়েছে ওই সাইকেলের মালিককে। ফার্নান্দো নিজেও অনেক বন্ধুর ফেলে যাওয়া সাইকেল খুঁজে পেয়েছিলেন পথেঘাটে। ২৫ বছর পরে তাঁর মাথায় আসে স্মারক তৈরির কথা। একাই শুরু করেছিলেন কাজ, পরে ‘নিখোঁজ’ পরিবারের অনেকে এসে যুক্ত হন তাঁর সঙ্গে। গল্পটা তখন আর ফার্নান্দোর একার থাকে না। একটা মানুষ, একটা শহরকে ছাড়িয়ে গোটা দেশের ইতিহাস রচিত হয় দেওয়ালে-দেওয়ালে। ভোলার উপায় নেই আর, পথ চলতে গিয়ে চোখে পড়বে পরিত্যক্ত সাইকেলের গল্প। সুখের নয় সেই কাহিনি, তবু প্রিয় মানুষের প্রিয় বাহনকে আপন করে নেওয়ার মধ্যেও তো লুকিয়ে থাকে নস্টালজিয়ার হাতছানি।

আরও পড়ুন
সাইকেল চালাতে চেয়ে দেশ ছাড়া দুই আফগান বোন

ফার্নান্দোর প্রচেষ্টা শুধু স্মৃতিকথার মধ্যে থেমে থাকেনি। তাঁর ‘সাইকেল’ হয়ে উঠেছে একটা চিহ্ন—প্রতিবাদের, আশার। দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ এখন হারানো প্রিয়জনের খোঁজে প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে স্টেনসিলের সাইকেলকে। ঘরের কোণে বসে চোখের জল ফেলাটার গল্পটা মিশে যায় আরো বড়ো এক উদ্দেশ্যের সঙ্গে। যুদ্ধে যারা ‘হারিয়ে’ গেছে, তারা ফিরবে না আর। কিন্তু আজও যাদের সম্ভাবনা আছে প্রত্যাবর্তনের, তাদের জন্য এক চিলতে আশা হয়ে বেঁচে থাকে ফার্নান্দোর সাইকেল।

আরও পড়ুন
নেতাজির বার্তা ছড়াতে সাইকেলে ভারতভ্রমণ কিশোরের

Powered by Froala Editor

Latest News See More