সাইকেল চালাতে চেয়ে দেশ ছাড়া দুই আফগান বোন

বছর ছয়েক আগের কথা। আফগানিস্তানের উত্তরে অবস্থিত ফারিয়াব প্রদেশে প্রথমবারের জন্য আয়োজিত হয় আশ্চর্য এক প্রতিযোগিতা। বাইসাইকেল রেস। গোটা শহর জুড়ে টাঙানো হয়েছে তার পোস্টার। পাড়ায় পাড়ায় অটোরিক্সা চেপে ঘোষণা করছেন আয়োজকরা। এ ডাক ফেরাতে পারেননি দুই আফগান কিশোরী। ইয়ুলদুজ (Yulduz Hashimi) এবং ফারিবা হাশিমি (Fariba Hashimi)। একজনের বয়স ১৪, অন্যজন ১৭-তে পা দিয়েছেন সবে। দুই বোনের চুক্তি হয়েছিল, বাবা-মাকে না জানিয়েই এই রেসে অংশ নেবেন তাঁরা। সে-সব না হয় হল। কিন্তু সমস্যার ব্যাপার হল, সাইকেল চালানোই যে জানেন না তাঁরা। এমনকি নিজেদের সাইকেলও যে নেই তাঁদের। প্রতিবেশি এক পুরুষ বন্ধুর থেকে সাইকেল ধার করেই সাইকেল চালানো শিখেছিলেন ইয়ুলদুজ এবং ফারিবা। তার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মুখে কাপড় বেঁধে, পুরুষ সেজে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। আর তাতেই বাজিমাত। প্রথম এবং দ্বিতীয় পুরস্কার ঝুলিতে পুরেছিলেন দুই বোন। 

এই গল্প শুনতে অনেকটা রূপকথার মতোই। তবে আফগান এই দুই বোনের গল্প এখন মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইউরোপে। সম্প্রতি ইতালিতে আয়োজিত হয়েছিল ইউসিআই গ্র্যাভেল চ্যাম্পিয়নশিপ। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরাও। আর এই রেসে যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৯ নম্বর স্থান অর্জন করলেন দুই বোন। না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকলেও, এই সাফল্য কম নয় মোটেই। কারণ, এই রেস ইউরোপে আয়োজিত কঠিনতম সাইকেল রেসগুলির মধ্যে অন্যতম। যেখানে ইউরোপের বহু সাইক্লিস্টই এই রেস সম্পূর্ণ করার আগে হাল ছেড়ে দেন, সেখানে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে এই রেস শেষ করা মুখের কথা নয় মোটেই। 

হ্যাঁ, প্রতিকূল পরিবেশই বটে। কারণ, কৈশোর থেকে আফগানিস্তানের মরুভূমিতে বড়ো হয়ে ওঠা হাশিমি বোনেরা। শুষ্ক, পাথুরে পথে সাইকেল চালিয়েই অভ্যস্ত তাঁরা। অথচ, ইউরোপে আবহাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়ি পথ। তার ওপর বৃষ্টি লেগেই রয়েছে। পিচ্ছিল পথ যেন আরও বিপজ্জনক করে তোলে এই রেসকে। তবে সমস্ত প্রতিকূলতাকে টপকেই এক নতুন ইতিহাস গড়লেন তাঁরা। প্রথম আফগান মহিলা হিসাবে শেষ করলেন এই রেস। 

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, আফগান হলেও ইতালির সাইক্লিং দল ‘ভালকার’-এর হয়েই রেসের ময়দানে নামেন হাশিমি বোনেরা। আসলে, আফগানিস্তানের যে রাজ্যে বেড়ে ওঠা তাঁদের, সেখানে মহিলাদের সাইকেল চালানো অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল মার্কিন সমর্থিত সরকারের আমলেও। তাঁদের পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পর স্বাভাবিকভাবেই পাড়াপড়শিদের হিংসার শিকার হতে হয়েছিল তাঁদের। পথে-ঘাটে শুনতে হত কটূক্তি। রাস্তায় তাঁদের লক্ষ্য করে পাথরও ছোঁড়া হয়েছে বহুবার। বাবা-মায়ের থেকেও খুব একটা সমর্থন পাননি প্রাথমিকভাবে। পরে সাইক্লিং-এর নেশায় পালিয়ে যাওয়া কাবুলে। 

হাজার বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা টপকে ২০২১ সালে দেশের জাতীয় দলেও জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন ফারিবা এবং ইয়ুলদুজ। তবে সঙ্গ দেয়নি ভাগ্য। সে-বছর আগস্ট মাসেই আমেরিকার সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবানরা। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার স্বপ্ন অধরা থেকে যায় দুই বোনের। কিন্তু এভাবে কি নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দেওয়া যায়? হাল ছাড়েননি তাঁরা। 

ইয়ুলদুজ এবং ফারিবা যোগাযোগ করেছিলেন ইতালিয়ান সাইক্লিস্ট অ্যালেজান্দ্রা ক্যাপেলোটোর সঙ্গে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আফগান তরুণীদের। দুই বোনের দুর্দিনে সাক্ষাৎ দেবদূত হয়েই হাজির হন অ্যালেজান্দ্রা। জরুরি তৎপরতায় আফগানিস্তান থেকে তাঁদের নিয়ে আসেন ইতালিতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই দেন নিজের বাসস্থানে। তারপর তাঁর তত্ত্বাবধানেই শুরু হয় অনুশীলন। তবে আফগানিস্তানে তালিবান মহিলাদের ক্রীড়াজগৎ থেকে নিষিদ্ধ করায়, আফগান পরিচয়কে পাশে সরিয়ে রেখেই লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে ইয়ুলদুজ ও ফারিবাকে। ধীরে ধীরে ইউরোপের প্রকৃতির সঙ্গেও নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছেন দুই বোন। অনুপ্রেরণাদায়ক তো বটেই, মহিলা ক্ষমতায়নের এক নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে তাঁদের এই লড়াই…

Powered by Froala Editor