সংস্কারের অপেক্ষায় বালি-দেওয়ানগঞ্জের শতাব্দী প্রাচীন টেরাকোটার দুর্গামন্দির

ক্ষেত্র বিশেষে গ্রামটিকে অনেকেই চেনেন বালি নামে। তবে এই বালি হাওড়ার বালি নয়। হুগলির আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত গোঘাট-১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের গ্রামটির রেজিস্ট্রীকৃত নাম বালি-দেওয়ানগঞ্জ (Bali Dewanganj)। গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম মন্দিরক্ষেত্র। ২০০ বছরের পুরনো এক দুর্গামন্দির রয়েছে গ্রামটিতে। ঐতিহ্যপ্রেমীদের কাছে তো বটেই, ইতিহাসবিদদেরও পছন্দের বিষয় এই মন্দির। এর নিম্নাংশ জোড়-বাংলা শৈলীতে নির্মিত। উপরে নবরত্ন শৈলীর শিখর। এবং এটিই এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। 

জোড়-বাংলা মন্দিরের ছাদ মূলত চালা শৈলীর মুখাপেক্ষী। এতে সাধারণত দুটি (দো) চালা পাশাপাশি নির্মিত থাকে। বাংলা জুড়ে জোড়-বাংলা শৈলীর মন্দির খুঁজলেই চোখে পড়বে। বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই মন্দিরে নবরত্ন (ন’টি চূড়া) শৈলীর শিখর চিত্তাকর্ষক। এটি জোড়-বাংলার দো চালার মধ্যে। মোদ্দা কথা, বাংলার দুটি কুঁড়েঘরের ছাদ পাশাপাশি জুড়ে দিলে যেটা হয়, সেটাই ‘জোড়-বাংলা’। অন্যদিকে, নবরত্নটির দুটি তলা। এর প্রতিটি স্তরে চারটি চূড়া এবং একটি কেন্দ্রীয় চূড়া রয়েছে (৪ + ৪ + ১ = ৯)। চারদিকে খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। জোড়-বাংলা মন্দিরের উপর নবরত্ন তৈরি করেই নির্মিত এই দুর্গামন্দির। গোটা বাংলায় এমন শৈলীর মন্দির অদ্বিতীয়।

প্রবেশদ্বারের শীর্ষে বড়সড় মহিষাসুরমর্দিনীর টেরাকোটা প্যানেল। এত বড় মহিষাসুরমর্দিনীর পোড়ামাটির প্যানেল বাংলার আর কোনো মন্দিরে নেই। এতে দেবী দুর্গা সপরিবারে বিরাজমান। প্যানেলের প্রত্যেক দেবদেবীর জন্য আলাদা আলাদা প্যানেল বর্তমান। দেখলে মনে হবে, প্রত্যেকটিই ছোট ছোট মন্দির। পোড়ামাটির এই প্যানেলটির কেন্দ্রে দুর্গামূর্তির পাশেই ইঁদুরের উপর গণেশের পৃথক প্যানেল। এর ডানদিকে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। সরস্বতী-লক্ষ্মী উভয়ই পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে। বাঁ-দিকে ময়ূরের উপর উপবিষ্ট কার্তিক।

মন্দিরের জোড়-বাংলা অংশেও একটি ত্রিপল খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার রয়েছে। এর শীর্ষে খোদিত ঘোড়সওয়ার। গর্ভগৃহে প্রবেশের ঠিক উপরে দুটি ঘোড়া। অন্যান্য প্রবেশদ্বারগুলিতে একই রকম আলংকারিক উপাদান, যেগুলি সামাজিক দৃশ্য বলে মনে হয়। দৃশ্যগুলিতে শোভা পায় টুপি পরা ব্রিটিশরা, তারা কখনো রাইফেলধারী কিংবা কোনো মহিলার অ্যাক্রোব্যাট।

আরও পড়ুন
নিজবালিয়ায় দুর্গা পূজিত হন সিংহবাহিনী রূপে

দুর্ভাগ্যবশত, এই শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরটি আবহাওয়া এবং সময়ের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়নি। প্যানেলের দুর্গা মূর্তিটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সিংহ ও মহিষাসুরকে প্রায় দেখাই যায় না। কেবল তাদের পিছনের পা অবশিষ্ট। দুর্গার বাহুগুলিও ভেঙে গেছে। এখানে স্থাপিত মূল দেবতাকে একত্রিত করার চেষ্টা করতে হবে, যা ওড়িশায় দেখা দেবী মূর্তির সঙ্গে মিলে যায়। এই তত্ত্বটি তার পোশাকের শৈলীর পাশাপাশি দেবী সরস্বতী এবং লক্ষ্মীর পোশাকের সঙ্গেও মেলে।

আরও পড়ুন
গঙ্গাভাগের সাক্ষী কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো

যে ত্রিবঙ্গ (ত্রিভাঙ্গা/ ত্রিভঙ্গ) ভঙ্গিতে সরস্বতী ও লক্ষ্মী, সাধারণত শাস্ত্রীয় ওডিশি নৃত্যের ঘরানায় দেখা যায়। দেবী লক্ষ্মী এখানে দুটি পদ্মের কুঁড়ি ধারণ করে। সরস্বতীর হাতে বীণা। যদিও তাঁর বাদ্যযন্ত্রও এখন কালের নিয়মে বাজে না— ক্ষয়িষ্ণু। কেবল তাই-ই নয়, গণেশ এবং কার্তিকের মুখও সময়ের পরিহাসে ভঙ্গুর। তাছাড়াও, কুলুঙ্গিতে দুটি প্যানেল গণেশের জন্মকে চিত্রিত করে। একইসঙ্গে শিব-পার্বতী, ভাগীরথীর গঙ্গা আনয়নের কাহিনির স্থাপত্যও মন্দির গাত্রের ছোট খোপে দেখা মিলবে।

রাউতপাড়ার ভিতরে ১৯ শতকের এই দুর্গামন্দির। এলাকার মধ্যে দুর্গামন্দির ছাড়াও রয়েছে বিষ্ণুমন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির ও মঙ্গলচণ্ডী মন্দির। সর্বমঙ্গলা মন্দিরটি পঞ্চরত্ন শৈলীর একটি অসামান্য উদাহরণ হতে পারত। মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের ত্রয়োদশরত্ন (তেরোটি চূড়া) কমতে কমতে এখন একটিতে। হয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে শীঘ্রই। তাছাড়াও শিবকুঠির, রাসমঞ্চ, দালালপাড়ার লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, ঘোষপাড়ায় দামোদর মন্দিরও রয়েছে, যা বালি-দেওয়ানগঞ্জের আইকনিক দুর্গামন্দিরের কাছাকাছি। বিত্তশালী জমিদাররা এইসব মনোরম মন্দির এককালে তৈরি করেছিলেন। যদিও সেসব এখন অবহেলিত এবং বিপদজনক অবস্থায়।

গ্রামটির সংরক্ষণের অত্যন্ত প্রয়োজন। একইসঙ্গে প্রয়োজন এই মন্দিরগুলির সংস্কার। তবে, সংস্কারের নামে সিমেন্ট বালির প্রলেপ পোড়ামাটির সূক্ষ্ম কাজগুলির উপর লেপে দেওয়া চলবে না। চলবে না নতুন রঙের মারপ্যাঁচ। তাহলেই পূর্বের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে গ্রামটি। এরজন্য এই ঐতিহ্যবাহী গ্রামে অর্থ বিনিয়োগ করাও একান্ত প্রয়োজন।

Powered by Froala Editor