১২৮ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু বক্সিং ডে টেস্ট, এমন নামকরণের কারণ কী?

ভারতীয় ক্রিকেট দলের চলতি অস্ট্রেলিয়া খুব একটা যে আশানুরূপ হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। প্রথম টেস্ট ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ের সামনে মাত্র ৩৬ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল বিরাট-বাহিনী। সেই জায়গা থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামছে ভারত। তবে বক্সিং ডে টেস্টের পরিসংখ্যানের নিরিখে বিগত ৩৫ বছরের ইতিহাস এগিয়ে রাখছে অস্ট্রেলিয়াকেই। শেষ ৮টি বক্সিং ডে টেস্টের মধ্যে মাত্র ১টিতে জয় পেয়েছে ভারত। ২টি ম্যাচ শেষ হয়েছে অমীমাংসিতভাবে। বাকি ৫টিতেই জয় তুলে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। কাজেই ভারত-অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে।

কিন্তু ২৬ ডিসেম্বর আয়োজিত টেস্ট ম্যাচকে কেন বক্সিং ডে টেস্ট বলা হয়, তা নিয়েই থেকে যায় বিস্ময়। ক্রিকেটের অভিধানে ‘বক্সিং’-এর জায়গা পাওয়াই বা কীভাবে? কারণ বক্সিং ডে-তে ক্রিকেটের আয়োজন হলেও সেই অর্থে ব্রাত্য থেকে যায় স্বয়ং বক্সিং-ই। আপাতভাবে মনে হলেও, ক্রিকেটের সঙ্গে বক্সিংয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এই শব্দবন্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা। যা খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৫০ বছর। যদিও 

‘বক্সিং ডে’ কথাটির জন্ম হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে। রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালে। বড়োদিনের প্রেক্ষিতে সেসময় থেকেই ব্রিটেনে চল ছিল উপহার প্রদানের। কিন্তু উৎসবের আমেজ ফুরোলে বড়োদিনের পরেরদিন সেই বাক্স খোলা হত। তবে শুধু উপহারই নয়, ধনীরা ২৬ ডিসেম্বর সাধ্যমতো সামান্য অনুদানও বাক্সবন্দি করে তুলে দিতেন দরিদ্রদের হাতে। সেখান থেকেই দিনটির নামকরণ করা হয় বক্সিং ডে। আবার এই একই দিনের পৃথক ধর্মীয় গুরুত্ব আছে স্পেন এবং আয়ারল্যান্ডে। সেখানে সেন্ট স্টিফেন্স ডে হিসাবে পালিত হয় ২৬ ডিসেম্বর। 

রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকালেই বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ‘বক্সিং ডে’। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, বরং হাঙ্গেরি, জার্মানি, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসেও দ্বিতীয় বড়োদিন হিসাবে পালিত হত বক্সিং ডে। এখনও সেই নিয়ম মেনেই বন্ধ থাকে সমস্ত সরকারি অফিস। ছুটি দেওয়া হয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও। ব্রিটিশদের হাত ধরেই এই বক্সিং-ডে ঢুকে পড়েছিল ওশিয়ানিয়া মহাদেশে। উৎসবের একটি বাড়তি দিন হিসাবেই দিনটিকে গ্রহণ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মানুষেরা।

ছুটির দিনে মাঠে আসবেন বেশি সমর্থক। প্রাথমিকভাবে এই উদ্দেশ্য নিয়েই অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়েছিল বক্সিং ডে টেস্ট। সময়টা আজ থেকে প্রায় ১২৮ বছর আগের। ঐতিহাসিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১৮৯২ সালে বক্সিং ডে টেস্ট শুরু হয়েছিল ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের হাত ধরে। তবে আজকের বক্সিং ডে টেস্টের থেকে খানিকটা আলাদা ছিল তার সূচি। ২৬ তারিখে শুরু না হয়ে, এই দিনটাকে কেন্দ্র করেই ঠিক করা হত ম্যাচের তারিখ। 

এই রীতি বজায় ছিল তারপরের বছরগুলিতেও। নিয়ম মেনেই প্রতিবছর বড়োদিনের সময় মেলবোর্ন মেতে উঠত টেস্ট ক্রিকেটে। তবে সেই বক্সিং ডে টেস্ট কেবলমাত্র ক্লাব-ক্রিকেটে আটকে থাকল না। অস্ট্রেলিয়ারর দৌলতেই ১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হল বক্সিং ডে টেস্টের। ইংল্যান্ডে বিরুদ্ধে রুদ্ধশ্বাস সেই ম্যাচে ২৮ রানের জয় তুলে এনেছিল অস্ট্রেলিয়া।

আরও পড়ুন
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ভারতের সর্বনিম্ন স্কোর, লজ্জার মুখে বিরাট-বাহিনী

পরের দু’বছরও বক্সিং ডে-তে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট আয়োজিত হয়। তারপর সেই রীতিতে ১৫ বছরের ছেদ পড়ে। ১৯৬৭ সালে আবার শুরু। অ্যাডিলেডের মাঠে অস্ট্রেলিয়া খেলতে নেমেছিল ভারতের বিরুদ্ধে। তবে তখনও ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হত না এই টেস্ট ম্যাচ। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও এক দশক। ১৯৮০ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড এবং মেলবর্ন ক্রিকেট ক্লাব প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই নেয় বিশেষ উদ্যোগ। জানানো হয়, অ্যাশেজ আয়োজিত না হলেও প্রতি-বছরই তারা দায়িত্ব নেবে এই টেস্ট ম্যাচের। সেই সময় থেকেই সাম্প্রতিককালে অবিচ্ছিন্নভাবেই আয়োজিত হয়ে আসছে বক্সিং ডে ক্রিকেট।

তবে শুধু অস্ট্রেলিয়াই নয়, নিউজিল্যান্ডেও বক্সিং ডে টেস্ট আয়োজনের চল বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। সেই অনুযায়ীই আজ ভারতের পাশাপাশি মাঠে নামছে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডও। অন্যদিকে, ক্রিকেট ছাড়াও নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে বক্সিং ডে-তে ফুটবল, রাগবি, হকি, ঘোড়দৌড় এবং শিকারের মতো খেলাও আয়োজিত হত একসময়। হত বিশেষ প্রতিযোগিতাও। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব খেলা থেকে গুরুত্ব কমে গেছে এই দিনটার। শুধু তাই-ই নয়, হারিয়েছে দিনটির পরিচয়ও। এখন কেবলমাত্র সাধারণ ছুটি হিসাবেই মানুষের কাছে পরিচিত ২৬ ডিসেম্বর। তা সত্ত্বেও দিনটার পুরনো মাহাত্ম্য, ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে ধরে রেখেছে ক্রিকেট-দুনিয়া...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা

More From Author See More