বর্ষশেষের রাতে নেমে-আসা ‘অশরীরী’দের এড়াতেই শুরু হ্যালোউইন!

বছর ঘুরিয়া এল তাহাদের দিন। এই ‘তাহারা’ আসলে অশরীরী। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে হ্যালোউইন নিয়ে। পাশ্চাত্যের সীমানা পেরিয়ে, হলিউডি সিনেমার হাত ধরে ভারতীয় জীবনের সঙ্গেও রীতিমতো মিশে গেছে হ্যালোউইন ফেস্টিভাল। ভূতচতুর্দশীর পাশাপাশি ৩১ অক্টোবর ‘তেনাদের’ নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই ভারতেও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গেলে হ্যালোউইনের রীতি-রেওয়াজও বদলে যায় বেশ খানিকটা। উদযাপনের সেই পদ্ধতিও বেশ অদ্ভুত, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু এই সংস্কৃতির গোড়াপত্তন কোথায়? কীভাবেই বা সূত্রপাত এই উৎসবের?

আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগের কথা। কেল্টিক উপজাতির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল হ্যালোউইন ফেস্টিভাল। তবে আজকের মতো শুধুমাত্র উদযাপনের জন্যই পালিত হত না হ্যালোউইন। বরং, তার পিছনে লুকিয়ে ছিল ‘ভয়’। 

ঠিক কীরকম? সেই গল্পের হদিশ পেতে ঢুকে পড়তে হবে কেল্টিক লোককথায়, দিনপঞ্জিতেও। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১ নভেম্বর তারিখটিই কেল্টিক বর্ষপঞ্জিতে পালিত হয় নববর্ষ হিসাবে। বছরকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছিল কেল্টিকরা— গ্রীষ্ম এবং শীত। বছরের উজ্জ্বল ঋতু ছিল গ্রীষ্ম, অন্যদিকে শীতকে ধরা হত অন্ধকারের সময় হিসাবে। আর এই দুইয়ের ঠিক সংযোগমুহূর্ত ছিল সামহেইন। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যা ৩১ অক্টোবরের রাত। কেল্টিকদের বিশ্বাস ছিল, নববর্ষের ঠিক আগের এই রাতে উপরিপাতিত হয় সাধারণ মানুষের জগৎ ও ইহজগতের। আর দুই জগতের এই দূরত্ব মুছে যাওয়ায় রাতের অন্ধকারে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে রাক্ষস, পরী এবং মৃত আত্মারা। রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় অশরীরীরা। কিন্তু অবাধে যাঁরা সর্বত্র বিরাজমান, তাঁদের থেকে বাঁচার উপায় আছে কি?


আছে বইকি, আলবাত আছে। যদি তাঁদের ভিড়ে, তাঁদের মতো ছদ্মবেশ ধরেই মিশে যাওয়া যায়, তাহলে আলাদা করে আর ‘মানুষ’ চেনার উপায় নেই তেনাদের। হ্যাঁ, আত্মাদের থেকে আত্মগোপন করতেই ভূতের ছদ্মবেশ ধারণের প্রথা শুরু হয়েছিল হ্যালোউইনে। সেই সঙ্গে ‘অতৃপ্ত’ আত্মাদের সন্তুষ্ট রাখতে আয়োজিত হত ক্যাম্পফায়ার। খোলা আকাশের তলায় রেখে দেওয়া হত আহারাদি। পরিবারের সদ্যপ্রয়াত সদস্যদের অনুগ্রহ লাভের আশায় করা হত প্রার্থনাও। 

কেল্টিকদের এই রীতিই সপ্তম শতাব্দীতে গিয়ে পরিবর্তিত হয় ‘হ্যালোস ডে’ বা ‘এল সেন্টস ডে’-তে। পোপ তৃতীয় জর্জের হাত ধরে দিনটা হয়ে ওঠে খ্রিস্টান উৎসব। খ্রিস্টান মতানুসারেও বিশেষ এই দিনটায় মূলত শ্রদ্ধা জানানো হত মৃত সাধু-সন্ত এবং পরিবারের আত্মীয়দের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মঙ্গলকামনা করে গান গেয়ে ভিক্ষা চাইতেন খ্রিস্টান সন্তরা। ট্রিক অ্যান্ড ট্রিটের প্রচলনও সেখান থেকেই। তবে অর্থ নয়, বরং বিভিন্ন খাবার এবং টারনিপ সংগ্রহ করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। ষোড়শ শতকে আয়ারল্যান্ডে টারনিপের বদলে কুমড়োর প্রচলন শুরু হয়। প্রেতাত্মাদের কথা স্মরণ করে তাতে খোদাই করে আঁকা হত অশরীরীর মুখও। 

তবে সে যাই হোক না কেন, পরবর্তীকালে এই ‘হ্যালোস ডে’ থেকেই বিবর্তিত হয়ে জন্ম নেয় ‘হ্যালোউইন’ কথাটি। ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলসে সবথেকে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই উৎসব। হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন। গান-বাজনা, সারারাত ধরে বনফায়ার তো ছিলই; এমনকি আয়োজিত হত নানারকমের খেলাধুলো, অদ্ভুত পোশাক পরে প্যারেড। 

আঠারো শতাব্দীতে আমেরিকায় ইউরোপিয় উপনিবেশ স্থাপনের পর, ধীরে ধীরে সেখানেও শুরু হয়ে যায় হ্যালোউইন-যাপন। মূলত তখনও পর্যন্ত তা ছিল আইরিশ-আমেরিকানদের উৎসব। পরবর্তীতে হ্যালোউইনের শামিল হন নেটিভ আমেরিকানরাও। তবে যত দিন গেছে ব্যস্ততা বেড়েছে মানুষের। তাই রান্না করা খাবারের বদলে জায়গা করে নিয়েছে রেডিমেড ড্রাইফুড। বিশেষত ক্যান্ডি, চকোলেট। বাড়িতে হাতে তৈরি করা পোশাকের বদলে এসেছে বহুজাতিক সংস্থার তৈরি ‘হ্যালোউইন’ কস্টিউম। আর ‘তেনাদের’ ভয়? সেও হাওয়া হয়েছে মানসিকতার বদলের সঙ্গে সঙ্গে। 

তবে দু’হাজার বছরের এই রীতিতে কোপ পড়েছিল গতবছর। কোভিড মহামারীর কারণে থমকে গিয়েছিল হ্যালোউইনের উদযাপন। অবশ্য ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে যাওয়ার পর এবার পুনরায় স্বমহিমায় ফিরতে চলেছে হ্যালোউইন। অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন ইতিমধ্যেই ছাড় দিয়েছে উৎসবযাপনে। ব্রিটেনও হয়তো হাঁটবে সেই পথেই। ভারতে সেইভাবে পথেঘাটে ‘অশরীরী-বেশী’ মানুষজন না দেখা গেলেও, সোশ্যাল মিডিয়া যে উপচে পড়বে হ্যালোউইন উইশে— তাতে সন্দেহ নেই কোনো…

Powered by Froala Editor