স্কলারশিপ নিয়ে রাশিয়ায় পাড়ি, মেদিনীপুরের এই যুবক জড়িয়ে রুশ বিপ্লবের সঙ্গেও

সময়টা বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি আরেক ঐতিহাসিক ঘটনার প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া। যে ঘটনার যবনিকা পতন ঘটবে ১৯১৭ সালে। স্বৈরাচারী জারের শাসনে ইতি ঘটিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে তৈরি হবে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব। এমন একটা ঘটনা, যার তুলনা একমাত্র ব্যর্থ প্যারিস বিপ্লব ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে এই লড়াই শুধু রাশিয়ার মানুষের ছিল না। তার মধ্যেই গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন এক বাঙালি যুবক। মেদিনীপুরের বনেদি মুসলমান পরিবারের যুবক হাসান শাহিদ সোহরাওয়ার্দী সেদিন উপস্থিত ছিলেন সেই লড়াইয়ের ময়দানে।

১৯১৪ সালে স্কলারশিপ নিয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন হাসান। উদ্দেশ্য ছিল রুশ ভাষা শিক্ষা। অবশ্য এর পরেই ১৯১৫ সালে লন্ডনে চলে যান তিনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু এসবের মধ্যে রাশিয়ার বলসেভিক পার্টির কর্মকাণ্ড তাঁর মন ছুঁয়ে গিয়েছে। তাই অক্সফোর্ডের পড়াশুনো শেষ করে আবার ফিরে গেলেন রাশিয়া। তখন বিপ্লবের প্রস্তুতি তুঙ্গে। ১৯১৭ সালে যখন বিপ্লব সফল হল, তখন সেখানে হাসান একজন পরিচিত মুখ। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসাবে। তবে তার কিছুদিনের মধ্যেই আবার পাড়ি দিলেন প্যারিসের উদ্দেশ্যে। 

কিছু বছর প্যারিসে থাকার পর হাসান লেনিনের আহ্বানে ফিরে যান রাশিয়ায়। তবে তা স্থায়ীভাবে নয়। লেনিনের নির্দেশে এবার তিনি চলে গেলেন চিনে। সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে পরিচালনার ভার দেওয়া হয় তাঁর উপর। চিনের মনোরম প্রকৃতির মধ্যে তাঁর মনও মেতে উঠেছিল। জীবনের অধিকাংশ কবিতাই লিখেছেন এখানে বসে। এরপর আবার ফিরে গেলেন রাশিয়া। সেটা ১৯২৬ সাল। তারপর ৩ বছর ধরে মস্কো আর্ট থিয়েটার প্রকল্পের হয়ে কাজ করেছেন।

অবশেষে বিদেশের পাট চুকিয়ে ১৯৩২ সালে দেশে ফিরে এলেন হাসান সোহরাওয়ার্দী। প্রথমে হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি এবং তারপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। তবে এই দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাঁকে কোনোদিনই আকর্ষণ করেনি। পরাধীন দেশে মানুষের ঐক্যের পরিবর্তে তিনি দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ। আর তার মধ্যে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরই পরিবারের আরেক সদস্য হোসেন সোহরাওয়ার্দী। তাই শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন কবিতা লিখে আর শিক্ষকতা করে।

বাঙালির ইতিহাস খুঁজলে কবির সংখ্যা অবশ্য কম পাওয়া যাবে না। নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, তাঁদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলে সেই রেখা চাঁদ থেকেও দেখা যাবে। আর এইসব কবিদের অনেকেই ইংরেজি ভাষাতেও কবিতা লিখেছেন। কিন্তু তাঁদের সবার জীবন এমন বিচিত্র নয়। গোঁড়া মুসলিম পরিবারে ১৮৯০ সালে যে ছেলেটির জন্ম হয়েছিল, সেই যে স্কটিশ চার্চ কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে একেবারে রাশিয়ায় গিয়ে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবে সামিল হবে, এমনটা আশা করেননি কেউই। আর এসবের মধ্যে তাঁর কবিতাও কোথাও হারিয়ে যায়নি। সেই কবিতার স্বীকৃতি যেমন পেয়েছেন ইংল্যান্ডের কবি রবার্ট ব্রিজের কাছ থেকে, তেমনই মিলেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেও। 

কিন্তু দেশবাসী তাঁকে আদৌ কতটুকুই বা মনে রেখেছে? তাঁর চোখের সামনে দুভাগ হয়ে গিয়েছে দেশ। মুসলমান হওয়ার অপরাধে জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানেই কাটিয়েছেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। রাশিয়ার বিপ্লবের শরিক হয়ে নিজের দেশকে নিয়েও কি কোনো স্বপ্ন দেখেননি তিনি?

আরও পড়ুন
ট্রেন-দুর্ঘটনায় পা হারিয়েও থামেনি লড়াই, এভারেস্ট-সহ ৭টি শৃঙ্গ জয় করেছেন অরুণিমা

ঋণ – শামিম আহমেদ

Powered by Froala Editor

More From Author See More