নিজের দাড়িতে পিছলে মৃত্যু! আজও জাদুঘরে সংরক্ষিত সেই ‘ঘাতক’

ইতিহাস বলে, একসময় আফগান বা পাঠান রাজত্বের সময় দাড়ি ছিল পুরুষদের বীরত্বের প্রতীক। আর আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড় থেকে চলচ্চিত্র তারকা— সকলের কাছে দাড়ি একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট। পাল্লা দিয়ে সাধারণের মধ্যেও বেড়েছে দাড়ি রাখার চল। কিন্তু এই দাড়িই যদি কারোর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে? শুনতে আজগুবি লাগলেও, বাস্তবেই ঘটেছিল এমন ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে তার। বিস্তারিত বলা যাক তবে সেই গল্প।

যে সময়ের কথা হচ্ছে সেটা ষোড়শ শতক। অস্ট্রিয়ার ছোট্ট শহর ব্রাউনাউ ইন। যা সুপরিচিত বা কুপরিচিত অ্যাডলফ হিটলারের জন্মস্থান হিসাবেই। এই শহরেই প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে ঘটে গিয়েছিল এমনই অঘটন। দাড়ির জন্য মৃত্যু হয়েছিল খোদ শহরের মেয়রের।

হান্স স্টেইনিঞ্জার। তৎকালীন সময়ে গিনেস বুকের ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চিতভাবেই দাড়ির জন্য বিশ্ব রেকর্ড গড়তেন ব্রাউনাউ শহরের এই মেয়র। সেসময় ১.৭২ মিটার দীর্ঘ দাড়ি বানিয়ে রীতিমতো নজির গড়েছিলেন হান্স। যদিও, হান্সের দাড়ির দৈর্ঘ্য নিয়ে রয়েছে নানান মতভেদ। অন্যদিকে, তাঁর নিজের উচ্চতা ছিল বড়োজোর দেড় মিটার। দীর্ঘকায় এই দাড়ি কাঁধে নিয়েই ঘুরে বেড়াতেন হান্স। বলাই বাহুল্য হান্সের এই ‘কীর্তি’ রীতিমতো সেনসেশন ছিল সেসময়। 

১৫৬৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় ব্রাউনাউ ইন। সেদিনই ঘটে যায় বিপত্তি। না, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়নি হান্সের। ঘটে গিয়েছিল এক অদ্ভুত ঘটনা। যখন শহরের একাংশ গ্রাস করে নিয়েছে আগুনের লেলিহান শিখা, হান্স তখন ছিলেন নিজের অফিস কেবিনে। শহরে আগুন লাগার খবর এসে পৌঁছায় তাঁর কাছেও। ততক্ষণে অবশ্য দমকল বাহিনী গিয়ে পৌঁছেছে সেখানে। কিন্তু শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। রাস্তা জুড়ে মানুষের কোলাহল, বিশৃঙ্খলা। পরিস্থিতি শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত নিজেই মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেন হান্স। আর দোতলার কেবিন থেকে দ্রুততার সঙ্গে নামতে গিয়েই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। 

কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা দাড়ি কখন যে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল, তা টেরই পাননি হান্স। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সেই দাড়ির ওপরেই পা দিয়ে ফেলেন তিনি। নিজের দাড়ির জন্যই পিছলে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে যান হান্স। ছিটকে এসে পড়েন মেঝেতে। পাথর বাঁধানো মেঝের সঙ্গে আঘাতে রক্তপাত না হলেও, সংঘর্ষে ঘাড় ভেঙে যায় তাঁর। সাহায্যের জন্য ন্যূনতম আকুতিটুকুও করতে পারেননি হান্স। আর শহরের বাকিরাও তখন ব্যস্ত নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে। এসবের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। যখন নাগরিকদের নজরে আসে বিষয়টা, তখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

তবে জনদরদী মেয়রকে যোগ্য সম্মানজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়েই সেদিন বিদায় দিয়েছিলেন শহরের নাগরিকরা। মেয়রের শখের দাড়ি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সেই ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। সমাধিস্থ করার আগে হান্সের সাড়ে চার ফুটের দাড়ি কেটে দীর্ঘ একটি কাচের বয়ামে করে সাজিয়ে রাখা হয় তাঁর অফিসেই। পরবর্তীতে ব্রাউনাউ ইনের মিউজিয়ামে জায়গা পায় সেই দাড়ি। আজও ব্রাউনাউয়ের ঐতিহাসিক সেই জাদুঘরে গেলে দেখা মিলবে রাসায়নিকে সংরক্ষিত প্রয়াত মেয়রের সেই দাড়ি। পাশাপাশি নজর কাড়তে বাধ্য সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ লাগোয়া পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ ও হান্স স্টেইনিঞ্জারের বিশাল পাথরের মূর্তি। 

সাড়ে চারশো বছর পেরিয়ে এসে আজও হান্সের সেই দাড়ি অন্যতম আকর্ষণ ব্রাউনাউ ইন শহরের। প্রতিবছর এই ঘাতক দাড়ি দেখতেই ভিড় জমান বহু বহু পর্যটক। এমনকি হান্সের অফিস কেবিনও দর্শনীয় স্থান হিসাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে আজও… 

Powered by Froala Editor