মদ্যপ অবস্থায় পুনর্নির্বাচন ডেকে পদ খোয়ালেন প্রধানমন্ত্রী!

সুরার মহিমা নিয়ে নতুন করে বলার নেই কিছুই। দু’পাত্র পেটে পড়লে কত কি ঘটে যায় যাহা তাহা। কেউ আওড়াতে শুরু করে উর্দু শায়েরী, কেউ আবার ফোন করে বসে প্রাক্তন প্রেমিকাকে। প্রতি বছর মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ব্যক্তির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু নেশাগ্রস্ত হয়ে জাতীয় নির্বাচনের ডাক? কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না নিশ্চয়ই? তবে এমনই অবাক করা কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং নিউজিল্যান্ডের (New Zealand) প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister)। বিশ্বের ইতিহাসে ‘মাতলামো’-র এমন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়াই দায়। 

শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। সেটা ১৯৮৪ সাল। নিউজিল্যান্ডের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তখন রবার্ট মালডুন (Robert Muldoon)। এক দু’বছর নয়। ১৯৭৫ সাল থেকে টানা ৯ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করছেন তিনি। শুধু রাষ্ট্রনেতাই নয়, তিনি সেসময় ‘ন্যাশনাল পার্টি’-র দলনেতাও বটে। তাঁর কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব সমালোচিত হলেও, তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা। যার সৌজন্যে ১৯৭৮ এবং ১৯৮১-র নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার তৈরির দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন মালডুন। এক কথায় তাঁর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ডে এই সরকার হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। নিশ্চিত ছিল ভবিষ্যৎ। কিন্তু তিল তিল করে গড়ে তোলা তাঁর এই ‘সাম্রাজ্য’ তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়েছিল এক লহমায়। অ্যালকোহল যে তাঁর এমন সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে বসবে, তা কে-ই বা জানত?

সে বছর নিউজিল্যান্ডের সবথেকে বড়ো রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা ‘অ্যান্টি পারমাণবিক বিল’। বিশ্বে পরমাণু শক্তির রেষারেষিতে রেশ টানাই ছিল সরকার বিরোধী দলের প্রস্তাবিত এই বিলের লক্ষ্য। তবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রীদের মত ছিল না এই বিলের পক্ষে। মার্কিন ততদিনে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েতের বাইরেও বহু উন্নত দেশই মজুত করে ফেলেছে পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র। সেখানে নিছক ‘শান্তি’-র বার্তা দিয়ে কি ঠেকানো যাবে ক্ষমতার আগ্রাসন? বরং, নিরাপত্তা জন্য দেশেও মজুত থাকুক পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। এমনটাই চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে বিরোধীদের প্রস্তাবকেই সমর্থন জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মালডুন। 

এরপরই নাটকীয় বাঁক নেয় পরিস্থিতি। মালডুনের সমালোচনার ঝড় ওঠে খোদ ন্যাশনাল পার্টির অন্দরমহলে। নেপথ্যে ছিলেন একাদিক উচ্চপদস্থ দলীয় সদস্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে, ১৯৮৪ সালের ১৪ জুন জরুরি বৈঠকের ডাক দেন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী। এই বৈঠক বেশ ভালো মতোই উত্তপ্ত হতে চলেছে, তা আগে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মালডুন। মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুপুর থেকেই তাই তিনি শরণাপন্ন হয়েছিলেন ভদকার। 

আরও পড়ুন
মদ্যপ অবস্থায় সরু রাস্তায় বিমান অবতরণ, আমেরিকাকে চমকে দিয়েছিলেন যে ব্যক্তি

শুরু থেকে একাদিক কূটনৈতিক প্রস্তাবের মাধ্যমে বৈঠকের চালকাসনে মালডুন বসে থাকলেও, গোলযোগ বাঁধে শেষলগ্নে। তাঁরই মন্ত্রিসভার মন্ত্রী মেরিলিন ওয়ারিং জানান, আগামী নির্বাচনে তিনি সমর্থন করবেন না মালডুনকে। দরকারে স্বতন্ত্রভাবে ভোটে দাঁড়াবেন তিনি। মেরিলিনের এই বিরুদ্ধাচরণই আকস্মিক উত্তেজিত করে তোলে নেশাগ্রস্ত মালডুনকে। ১৪ জুন সন্ধেতে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পুনর্নির্বাচনের ডাক দেন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অসংলগ্ন বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেন রবার্ট মালডুন। 

আরও পড়ুন
বর্ণাশ্রম প্রথা ছিল দেবতাদের মধ্যেও, ইন্দ্রের সঙ্গে মদ্যপানে মানা অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের!

তিনি যে ভুল করে ফেলেছেন, তা নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন মালডুন। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া প্রস্তাব তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। ঠিক এক মাসের মাথাতেই আয়োজিত হয় স্ন্যাপ নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনই উল্টে দেয় সমস্ত রাজনৈতিক সমীকরণকে। ৯৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে বিরোধী দল লেবার পার্টি। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে যা রেকর্ড। বলাই বাহুল্য, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেয়েছিল বিরোধী দল। প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো তো বটেই, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য মালডুনকে হিসেব চোকাতে হয় দলীয় স্তরেও। রাতারাতি দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে ফেলা হয় তাঁকে। 

আরও পড়ুন
আকণ্ঠ মদ্যপান করে, জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল বাপ্পা

অবশ্য নিজের কেন্দ্র থেকে নির্বাচন জেতার সুবাদে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব করেছেন মালডুন। কিন্তু তাঁর তৈরি করা কিংবদন্তি মুছে গিয়েছিল এক নিমেষেই। পুনর্নির্বাচনের ডাক না দিলে হয়তো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না তাঁকে। পারমাণবিক শক্তি বিলের টালবাহানাও হয়তো থিতিয়ে পড়ত কিছুদিন পরেই। শুধুমাত্র নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একটিমাত্র সিদ্ধান্তই বদলে দিয়েছিল তাঁর ভাগ্য। মদ্যপ প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ক্ষেপিয়ে তুলেছিল দেশের সাধারণ মানুষকে। তবে এত কিছুর পরেও ব্যক্তিগত জীবনে কি অ্যালকোহল পরিত্যাগের পথে হেঁটেছিলেন তিনি? সেই উত্তর অবশ্য জানা নেই…

Powered by Froala Editor

Latest News See More