হারিয়ে যেতে-যেতেও ‘কামব্যাক’; বম্বেতে বসেই ‘তুমি যে আমার’ রেকর্ড করলেন গীতা দত্ত

কলকাতার শুটিংপাড়ার আরেক ব্যস্ত দিন। শুটিংয়ের কাজের মাঝে একটু বিরতি মিলেছে। এক জায়গায় গোল হয়ে বসে আছেন উত্তমকুমার, অজয় কর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন ইউনিটের সদস্য। আলোচনা চলছে ছবির গান নিয়ে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, বম্বেতে রেকর্ডিং হবে। সুচিত্রা সেনের লিপে তো নিশ্চয়ই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাইবেন! ‘না’, বললেন হেমন্ত। এবার গাইবেন গীতা দত্ত। ইউনিটের সকলে চমকে গেল। তখন সুচিত্রা সেনের অভিনয় মানেই সন্ধ্যার গান— এমনটাই প্রায় রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে। তার জায়গায় গীতা দত্ত! যতই বিখ্যাত গায়িকা হন না কেন। উত্তমকুমারের কথায় শেষ পর্যন্ত বম্বে যাওয়া হল; এবং গানটা গাওয়ানো হল। বাকিটা? বাংলা সিনেমার কালজয়ী গানের যদি তালিকা করা হয়, তার মধ্যে এই গানটিকে কেউ বাদ দেবেন না নিশ্চয়ই। সিনেমাটির নাম ‘হারানো সুর’। আর গানটি ‘তুমি যে আমার’… 

একটা সময় কী বাংলা কী বম্বে, সারা ভারতে গান আর গীতা দত্ত ছিল সমার্থক। আর অতীতচারণ কেন, এখনও একইভাবে রয়ে গেছে সেইসব অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। গীতা দত্তের গায়কি, তাঁর গলার সরস্বতীর সুরেলা বীণার আওয়াজ আজও মোহিত করে দিয়ে যায় আমাদের। জীবনেও কম রাগ বয়ে যায়নি। জন্মেছিলেন রাজার হালে। ফরিদপুরের জমিদার বাড়ির মেয়ে হয়ে বেড়ে উঠছিলেন। সেখান থেকেই গানের পরিবেশে যাতায়াত। কিন্তু আরামের সেই দিন তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেশ চলে এসেছিল এই বঙ্গেও। জাপানি সেনা, তাঁদের বোমারু বিমানের ভয়ে কলকাতা তো বটেই, গ্রাম-গঞ্জ থেকে লোক পালাতে লাগল। ফরিদপুরের অত বড়ো জমিদারি ছেড়ে বম্বে চলে গেলেন দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়চৌধুরী। বাবার হাত ধরে চলে এলেন ছোট্ট গীতাও। সেই পা রাখা বম্বে শহরে। তখনও কি ভেবেছিলেন, এই শহরেই একদিন রানি হয়ে উঠবেন তিনি? 

এককালের জমিদার তখন শহরের ফুটপাথে জীবন কাটাচ্ছে। অতি দরিদ্র অবস্থা তাঁদের। এমন দিনে একটা জিনিস গীতার সঙ্গ ছাড়েনি— সুর। যেন ঈশ্বরপ্রদত্ত গলা তাঁর; তীক্ষ্ণ নরম সুর, অথচ কীসের একটা আকুতি। মোচড় দিয়ে ওঠে বুক। হিরে চিনতে ভুল করেননি আরেক বঙ্গ প্রতিভা, শচীন দেব বর্মণ। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক হিট ছবি, হিট গান। ভারতের সঙ্গীত জগতে তৈরি হল আরেক কিংবদন্তি ধ্রুবতারা, গীতা দত্ত… 

এই ‘দত্ত’ পদবি যুক্ত হওয়ার পেছনের গল্পটিও বেশ ‘ফিল্মি’। সিনেমা করতে করতেই দুজনের প্রেম। অনেকটা ‘টু স্টেটস’-এর মতোই। ভিন রাজ্য, ভিন্ন সংস্কৃতি। স্বাভাবিকভাবেই দুই পরিবারের কেউই প্রথমে মানতে চায়নি সম্পর্ক। বিয়ে তো দূরের কথা। অতঃপর, প্রেমে পাগল দুই তরুণ তরুণীর চার হাত এক হওয়া। গোটা বলিউড হাজির হয়েছিল বলা যায়। কিন্তু স্বপ্ন জিনিসটা বড়োই অদ্ভুত। আর বাস্তব শক্ত কঠিন মেঝের মতো। তাতে এক ফোঁটাও আবেগের রস নেই। স্বভাবে গীতা দত্ত ছিলেন আবেগপ্রবণ। অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তা নাহলে অমন গানগুলো ওই গভীরে ঢুকে কেউ গাইতে পারে! ওইরকম ভার্সেটাইল গানের সম্ভার তখন গীতা দত্ত ছাড়া খুব কম জনেরই ছিল। বোহেমিয়ান স্বভাবটা বিয়ের পর যেন খাঁচায় বাঁধা পড়ে যায়। ফলে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলেন। 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরই যেন সম্প্রচারিত হয় এই গান, আকাশবাণীকে নির্দেশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

বাঙালির রক্তে ‘কামব্যাক’ শব্দটা বরাবর রয়ে গেছে। হালের সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হোক, বা গীতা দত্ত। যখন মনে হচ্ছিল যে আশা ভোঁসলের আগমনে তিনি ছিটকে যাবেন, তখনই তিনি ফিরে এসেছেন প্রবলভাবে। হিন্দি সিনেমাতে তো বটেই, বাংলাতেও। একদম শুরুতে যে গল্পটা করা হল, ‘তুমি যে আমার’ সেই কামব্যাক সিরিজেরই ফসল। আর এখানে ঢুকে পড়বেন আরও একজন কিংবদন্তি কোকিল-কণ্ঠী। লতা মঙ্গেশকর। ভারতীয় সঙ্গীত জগতের সর্বকালের দুই সেরা সঙ্গীতশিল্পী একই সঙ্গে কাজ করেছেন। কাছাকাছিই বয়স ছিল দুজনের। তাঁদের ঘনিষ্ঠজনের মতে, লতা মঙ্গেশকর তাঁর গোটা জীবনে একমাত্র গীতা দত্তকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভয় পেতেন। এখনও হয়তো মনে পড়ে ১৯৭২-এর কথা। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তাঁর ‘সহেলী’। 

সেই সত্তরের দশক। কলকাতা জ্বলছে। ভারতে তখন বিপ্লবের ডাক। কয়েক বছর পরেই জরুরি অবস্থা জারি হবে। মুম্বইতে বসে বসে ধুঁকছেন গীতা দত্ত। তাঁকে ভুলে গেছে গোটা ইন্ডাস্ট্রি। কেউ আর মনে রাখেনি। তেত্রিশ বছর কি পেরিয়ে গেছিল? মদ, নেশা— কোনো কিছু বাদ ছিল না। গুরু দত্ত তার আগেই চলে গিয়েছিলেন। একা, সর্বস্বান্ত হয়ে পরাজিত রানি গীতা দত্ত। আর বলিউড? ফিরেও তাকায়নি। ‘না যাও সাইয়াঁ’… গান না, সুর না, রক্ত দিয়ে শেষ হল ‘সহেলী’র জীবন।    

আরও পড়ুন
জুটি বেঁধে বাংলা গান, চলে গেলেন জনপ্রিয় ‘কার্তিককুমার-বসন্তকুমার’-এর শেষজনও

তথ্যসূত্র- 

১) এই সময় ব্লগ, ‘তুম রহে না তুম- ২’ 

আরও পড়ুন
‘বিবিধ গানে’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যদি নিজেকে আরও একটু বেশি করে দিতেন!

২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘গীতা দত্তকে আজও মিস করেন লতা’ 

৩) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’

আরও পড়ুন
১৪টি দেশের ৩২৫ জন শিল্পী জুড়লেন গানে, লকডাউনে বিশ্বরেকর্ড ভারতীয় সুরকারের

৪) মহানগর ২৪X৭, ‘সুরের গীতা’

Powered by Froala Editor

More From Author See More