নিজেকেই শত্রু ভাবলেন আইনস্টাইন, অনুশোচনায় দগ্ধ ওপেনহাইমার-ফেইনম্যানও

১৯৪৫ সাল। আগস্ট মাসের সমস্ত কাগজের শিরোনামে জায়গা করে নিল একটাই খবর। দু’দুটো বীভৎস, ভয়ানক বোমা জাপানের দুটি শহরকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। এরকম ধ্বংসলীলা এর আগে দেখাই যায়নি। শহর দুটোর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। আর মানুষ? সেই বর্ণনায় নাই বা যাওয়া হল। কিন্তু গোটা বিশ্ব জেনে গেল, আমেরিকা নামক দেশের কাছে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র! যা দিয়ে শুধু শহর নয়; কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত পঙ্গু করে রাখা যায়!

ফিরে যাওয়া যাক আরও বেশ কিছু বছর আগে। আমেরিকার শান্ত নির্জন জায়গা ওক রিজে রাতারাতি একটা শহর গড়ে উঠল। ভেতরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় চলতে লাগল সমস্ত কাজ। কিন্তু কী এমন কাজ, যার জন্য এমন ব্যবস্থা? এই তৎপরতার গোড়া খুঁজতে গেলে আরও কিছু বছর আগে যাওয়া দরকার। ১৯৩৯ সাল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখলেন বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর শঙ্কা অনুযায়ী, জার্মান নাৎসি বৈজ্ঞানিকরা নিউক্লিয়ার ফিশনের মাধ্যমে হয়ত কোনো শক্তিশালী বোমা বানানোর পরিকল্পনা করছে। যদি তাঁরা সফল হয়, তবে নাৎসরা ছারখার করে দেবে পৃথিবী। এদিকে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশেও পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানীর অভাব নেই। যদি এদিক থেকেই প্রচেষ্টাটা দ্রুতগতিতে শুরু হয়, তাহলে তাঁদের আটকানো যাবে। 

এই একটা চিঠি বিশ্বযুদ্ধের ছবিটাকেই বদলে দিল। এরপরই খুব গোপনে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের কাজ শুরু হয়। আইনস্টাইন কখনই প্রত্যক্ষভাবে এর সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। কিন্তু যারা ছিলেন, তাঁরাও প্রত্যেকে কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। ওপেনহেইমার, এনরিকো ফার্মি, হান্স বেথ, ফ্রাঙ্কো রাসেট্টি, রিচার্ড ফেইনম্যান-সহ আরও অনেক বিজ্ঞানী এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বিজ্ঞানের কাজে সবাই তন্ময় হয়ে রয়েছেন। একটাই উদ্দেশ্য— জার্মানিকে যেভাবেই হোক হারানো। যেভাবেই হোক বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করা… 

দিনের শেষে সবই হল। ‘লিটল বয়’, ‘ফ্যাট ম্যান’ নিজেদের কাজ দেখাল। আমেরিকা-ব্রিটেনের উল্লাস সব জায়গায় পৌঁছে গেল। আর তা ঢেকে দিল জাপানের হাহাকার। কয়েক লাখ মানুষ চোখের নিমেষে ছাই হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড আগেও যা পরিপূর্ণ শহর ছিল, তা বদলে গেল শ্মশানে। তাসের দুটো পিঠের মতো বেজে চলল সিম্ফনি। আর বিজ্ঞানীরা? রাষ্ট্রনায়কদের পুতুল হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো গতি যে ছিল না। এই বিস্ফোরণের বহু আগেই এর সম্ভাব্য ফলাফলের ব্যাপারে আঁচ পেয়েছিলেন আইনস্টাইন। এবং তিনি বহুবার সেই কথা জানাতে চেয়েছিলেন; যেহেতু তাঁর চিঠির ওপর ভিত্তি করে সব শুরু হয়েছিল। তিনি সরাসরি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না; কিন্তু দিনের শেষে বারবার বলেছেন, “শত্রু আর কেউ নয়, শত্রু আমি নিজেই!” এই ব্যথা সারাজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছেন এই কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। 

অনেকেরই মনে পড়বে ওপেনহেইমারের সেই বিখ্যাত উক্তি। পারমাণবিক বোমা বানানোর আগে তার একটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। তা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ওপেনহেইমার। বিজ্ঞানীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিতও। সেই বিস্ফোরণ দেখে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপদর্শনযোগের একটি শ্লোক- 

“দিভি সূর্য সহস্ত্রাস্য ভভেদ যুগপদ উত্থিত

আরও পড়ুন
মৃত্যুর দেড় বছর পর, স্ত্রী-কে হৃদয়বিদারক চিঠি লিখলেন নোবেলজয়ী রিচার্ড ফাইনম্যান

যদি ভাহ সাদরাশি সঃ স্যত ভাসাস্তাস্যা মাহাত্মানা”

দিনের শেষে নিজেকে ধ্বংসকারী এক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। 

ম্যানহাটন প্রোজেক্টে একজন প্রতিশ্রুতিমান জুনিয়র বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রিচার্ড ফেইনম্যান। পরবর্তীকালে নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। একটা জায়গায় বলছেন- “ওই জায়গা থেকে ফিরে এসে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। নিউ ইয়র্কের একটা রেস্তোরাঁর ভেতরে বসে বাইরের পৃথিবীটাকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, হিরোশিমার কতদূর পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে? যত বাড়ি ছিল সব ভেঙে গিয়েছিল… সবকিছু গুঁড়িয়ে গিয়েছিল… দিন এগোবে, আবার নতুন করে রাস্তাঘাট তৈরি হবে। কিন্তু কেউ কি কোনোদিনও বুঝবে?”

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁকে নিয়ে সংকলন; স্পনসর আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ

ঠিকই বলেছিলেন ফেইনম্যান। প্রতিটা যুদ্ধ যায়, মিশাইল ছুঁড়ে শক্তি প্রদর্শন চলে, রাষ্ট্রের আস্ফালনে মুগ্ধ হয় ভক্তরা। আর বাকিরা? তাঁদের কথা কেউ কি কোনোদিনও বুঝবে? ১৯৪৫-এর থেকে আরও বেশি পরমাণু অস্ত্র আজ মজুত রয়েছে বিশ্বে। তার এক একটির ক্ষমতা আগেরগুলোর কয়েকগুণ বেশি। ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’— এই কথাতেই কি শেষ হয়ে যাবে সবটা? নাকি তেজস্ক্রিয় বিষবাস্পে শ্বাস নিতে না পেরে মরে যাবে সাদা পায়রাটা? উত্তর জানা নেই… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More