ধুঁকছে মেদিনীপুরের পালাগান, দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে স্বেচ্ছাসেবীরা

“বিগত দেড় বছর ধরে বন্ধ সমস্ত পালাগানের আসর। এর মধ্যে কোভিডের পাশাপাশি আমফান এবং ইয়াসে বিধ্বস্ত পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিন্তু পালাগানের যে শিল্পীরা, তাঁদের সংকট কি শুধুই আর্থিক সংকট? আমার তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে শিল্পের স্বাদ থেকে বঞ্চিত।” বলছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা ‘হৃদি-পল্লব’-এর সদস্য সৌম্যদীপ দাস।

পূর্ব মেদিনীপুরের একটি অতি পরিচিত লোকশিল্প পালাগান। কেউ কেউ একে সয়লা বা মায়ের গানও বলে থাকেন। তিনদিনের এই আয়োজনের মূল কেন্দ্রে থাকে মনসামঙ্গলের কাহিনি। তার সঙ্গে আরও নানা পৌরাণিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে থাকে এক একটি পালা। বছরে তিন-চারমাসের এই অনুষ্ঠানই শিল্পীদের রোজগারের মূল উৎস। কোভিড সেই সুযোগটুকু কেড়ে নিয়েছে। “শিব-অন্নপূর্ণার সংসারে আজ সত্যিই চাল বাড়ন্ত। তাই বেহুলা-লখিন্দররা কেউ হাটে সবজি বিক্রি করতে বসেছেন। কেউ কাজের খোঁজে পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে।” বলছিলেন সৌম্যদীপ। তবে এই শিল্পীদের নিছক আর্থিক সাহায্য না দিয়ে ‘হৃদি-পল্লব’-এর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হল এক শৈল্পিক সম্মাননা অনুষ্ঠান। অবশ্য শিল্পীরা এখানে দর্শক। মঞ্চে তাঁদের জীবনকেই তুলে ধরেছেন নাট্যকার ও অভিনেতা সৌম্যদীপ। পালাগানের সঙ্গে জড়িত সমস্ত শিল্পীকে সম্মান জানিয়ে এই নাট্যাভিনয়ের আসর। যার শুরুতেই সম্মান জানানো হয়েছে সদ্যপ্রয়াত নাট্যকর্মী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে।

৪ জুলাই পাইকপাড়ি সৃজন স্কুলের হলঘরে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ‘আমার আমি’ নাটক। যে নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে পালাগানের শিল্পীদেরই জীবন। সৌম্যদীপ জানালেন, “এই নাটকের কাহিনির অনুপ্রেরণা কিন্তু একটি বাস্তব ঘটনা থেকেই পেয়েছি। বেশ কয়েক বছর আগে মালদার এক শিল্পী মঞ্চে উঠেছিলেন একটি জীবন্ত সাপ সঙ্গে নিয়ে। সেখানে সেই সাপ তাঁকে কামড়ায়। তবে মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই গ্রামবাসীরা তাঁকে দেবীর সাজে কলার মান্দাসে ভাসিয়ে দেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পালাগানের শিল্পীদের জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমি।” ৪ জুলাইয়ের পর এখনও পর্যন্ত নাটকটির ৪টি শো মঞ্চস্থ হয়েছে। আর প্রতিটা শো-এর শেষে দর্শকদের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন তাঁরা। সেই সাহায্যমূল্য তুলে দেওয়া হয়েছে দুঃস্থ পালাগান শিল্পীদের হাতেই। সঙ্গে দেওয়া হয়েছে একটি করে সম্মাননা স্মারক।

সৌম্যদীপ জানালেন, এই স্মারকগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে এক দুঃস্থ পটশিল্পী পরিবারের থেকে। বংশপরম্পরায় তাঁরা পটকেই জীবিকা হিসাবে বেছে নিয়েছেন। অথচ কোভিডের কারণে এখন বিভিন্ন মেলা বন্ধ। যে মেলাগুলি হচ্ছে, সেখানেও মানুষের আনাগোনা কম। ফলে দিনের পর দিন তাঁরা ছবি এঁকে গিয়েছেন, কিন্তু তা বিক্রি হয়নি। তাঁদের কাছ থেকে সেইসমস্ত পট কিনে নিয়েই পাশে দাঁড়াতে চেয়েছে ‘হৃদি-পল্লব’। এই অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সময় মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার তো রয়েছেই। সেইসঙ্গে রয়েছে শিল্পীদের শিল্পের সম্মান দেওয়ার তাগিদও। আগামীদিনে আরও বেশি শো-এর ভিতর দিয়ে আরও অর্থ সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশাবাদী সংগঠনের সদস্যরা। এভাবেই এক ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করে চলেছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
মুকেশের বাংলা গানে আপত্তি গ্রামাফোন কোম্পানির, ‘প্রতিশোধ’ নিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পথে-পথে গান শুনিয়েই উপার্জন, ভগবান মালিকে নতুন বেহালা উপহার নগরপালের

More From Author See More