কৃষ্ণের দ্বারকার সন্ধানে কী কী খুঁজে পেলেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা?

কৃষ্ণ (Krishna) বাস্তব চরিত্র কিনা বা দ্বারকা (Dwarka) বাস্তব নগরী কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবু ইতিহাসের স্বার্থে কল্পিত এই নগরীটিকে নিয়ে গবেষণা হয়ে চলেছে। পুরাণ বলে, শহরটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর মৃত্যুর পর জলে ডুবে যায় শহরটি। গুজরাতের আধুনিক দ্বারকা জেলায় আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত দেবভূমি দ্বারকা। প্রাচীন শহরটি ডুবে যাওয়ার সঠিক সময় অনুমান করা কঠিন। যদিও কিছু প্রমাণ অবশ্য রয়েছে। তাতে নগরীটি কেন ডুবে গিয়েছিল, অনুমান করা যেতে পারে।

ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এ বিষয়ে গবেষণা ও খননকার্য চালিয়েছে। এর ফলে কিছু তথ্য যে উঠে এসেছে, তা বলাই বাহুল্য। শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই প্রলয় বা বন্যায় শহর ডুবে যাওয়ার মতো ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। ১৯৬৬ সাল। বিজ্ঞানী ডোরাটি ভিটালিয়ানোর হাত ধরে ভূতত্ত্বের একটি শাখা হিসাবে জিওমিথোলজি প্রতিষ্ঠা। উদ্দেশ্য, কোনো পৌরাণিক কাহিনির পিছনে ভূতাত্ত্বিক ঘটনার অনুসন্ধান।

সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা 'মহাবিশ্বের স্রষ্টা', বিষ্ণু হলেন 'বিশ্বের ধারক', শিব 'মহাবিশ্বের প্রলয়ংকারী'। বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণ। তাঁর জন্মদিনটি দ্বারকা ও মথুরাসহ সারাদেশে জন্মাষ্টমী হিসাবে পালিত হয়। ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে কৃষ্ণের জন্ম, লালন-পালন, তাঁর বাল্যলীলা, কংস-বধ, মথুরায় প্রত্যাবর্তন, দেশান্তর, দ্বারকার প্রতিষ্ঠা, যাদবদের পরাক্রম ও পতনের কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও 'মহাভারত' এবং 'বিষ্ণুপুরাণ'-সহ অন্যান্য গ্রন্থেও কৃষ্ণ বিষয়ক নানান কথা জানা যায়।

'শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ' এবং মহাকাব্য 'মহাভারত' অনুসারে, মগধ-নরেশ কংস-বধের কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন জরাসন্ধ। কারণ কংস ছিলেন তাঁর দুই কন্যা অস্তি ও প্রক্ষীর স্বামী। জরাসন্ধ ১৭ বার মথুরা আক্রমণ করেছিলেন। প্রতিবারই কৃষ্ণ এবং বলরাম বর্মের মতো দ্বারকাকে রক্ষা করেন। জরাসন্ধ ১৮তম বার আক্রমণ করলে মথুরার পরাজয় একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। তখন কৃষ্ণ নগরবাসীসহ দ্বারকায় আসেন। এখানেই প্রতিষ্ঠা পায় একটি নতুন শহর।

আরও পড়ুন
শ্রাবণ জুড়ে মনসামঙ্গল-পাঠের মধ্যে বহমান চাতুর্মাস্যের পুরাণপাঠের স্মৃতি

কথিত রয়েছে, কৃষ্ণ এই নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদ্রের কাছ থেকে ১২ যোজন (এক যোজন - সাত থেকে আট কিলোমিটার) জমি পেয়েছিলেন। শহরটির নির্মাতা বিশ্বকর্মা। প্রাসাদ এবং নগরবাসীর জন্য বাড়ি তৈরি করা হয় এখানে। এদিকে, ততদিনে মথুরা ত্যাগ করার কারণে কৃষ্ণ 'রণছোড়' নামে পরিচিত। অন্যদিকে, দ্বারকার প্রতিষ্ঠাতা সেই তিনিই 'দ্বারকাধীশ'।

আরও পড়ুন
জরাসন্ধকে একা পেলে তবেই হত্যা, পরিকল্পনা আঁটলেন কৃষ্ণ

বিষ্ণুর সপ্তম অবতার শ্রীরামচন্দ্র। তিনিই 'মরিয়াদা পুরুষোত্তম'। অন্যদিকে, কৃষ্ণ 'পূর্ণ পুরুষোত্তম'। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর দ্বারকায় বন্যা হয়। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) প্রাক্তন প্রত্নতত্ত্ববিদ কে কে মহম্মদ বলছেন, মহাভারতের সময়কাল ১৪০০ বা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। 'শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ'-এ বলা হয়েছে, ১২৫ বছর পৃথিবী শাসন করার পর বৈকুণ্ঠের বাসিন্দা হয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এরপর সমুদ্র শ্রীকৃষ্ণের প্রাসাদ ব্যতীত সমস্ত জমি ফিরিয়ে নেয়।

তবে, হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের সময়ের অনুমানের মধ্যে প্রায় ১৫০০ বছরের পার্থক্য রয়েছে। পুরাণ বিশেষজ্ঞ দেবদত্ত পট্টনায়েক, দ্য কিংডম অফ দ্বারকা, ডিসকভারি চ্যানেলে বলছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর কৌরবদের মা গান্ধারীর কাছে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। সন্তানশোকে যন্ত্রণাবিদ্ধ গান্ধারী শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যাদব রাজবংশ তাঁর চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে যাবে। গান্ধারীর অভিশাপ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ৩৬ বছর পর সত্যি হয়।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে রাজধর্ম পালন করে যুদ্ধের পরামর্শ দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এই উপদেশই ‘ভগবদ্গীতা’। হিন্দুরা এই দিনটিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে 'গীতা জয়ন্তী' হিসেবে পালন করে আসছে। এবছর ৫ হাজার ১৬০তম গীতা জয়ন্তী পালিত হবে। এভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ এবং গান্ধারীর অভিশাপ পূরণের মধ্যে প্রায় ৩৬-৩৭ বছরের ব্যবধান লক্ষণীয়।

১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে দ্বারকার দ্বারকাধীশ জগৎ মন্দিরের কাছে একটি বাড়ি ভাঙার সময় মন্দির চূড়ার সন্ধান মেলে। এরপর এই খননকার্যের দায়িত্ব নেয় পুণের ডেকান কলেজ। নবম শতাব্দীর বিষ্ণু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায় খননকার্যের পর। তাছাড়াও অন্যান্য জায়গাতেও মেলে আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। বিজ্ঞানীদের অনুমান, দ্বারকা একাধিকবার ধ্বংস হয়েছিল। যদিও স্থানীয়দের বিশ্বাস, দ্বারকাকে ছ'বার সমুদ্র গ্রাস করেছে। বর্তমান দ্বারকা হল সপ্তম দ্বারকা।

ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ বিভাগের প্রাক্তন মহাপরিচালক এবং প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শিকারিপুর রঙ্গনাথ রাও কর্নাটকের বাসিন্দা হলেও গুজরাতেও রয়েছে তাঁর বসত। গুজরাতেই তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওশানোগ্রাফির হয়ে জলের নিচে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৮৯ সালের দিকে অনুসন্ধানের সময়, সমুদ্রের ঘাস এবং বালির নীচে আয়তক্ষেত্রাকার পাথর পাওয়া গিয়েছিল। গবেষকদের মতে এটি একটি কাঠামোর অংশ। এ ছাড়াও কিছু অর্ধবৃত্তাকার পাথর পাওয়া যায়। সন্ধান মেলে চুনাপাথরের প্রমাণ সাইজের নোঙরের। মজার ব্যাপার, ছেনি দিয়ে গর্ত করা নোঙরটি। বহু শতাব্দী ধরে আশপাশের এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত এই চুনাপাথর। আন্তঃলক বা কাঠ ভরাটের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এই পাথর বলে গবেষক তথা সমুদ্র বিজ্ঞানীদের ধারণা। পাওয়া যায় মৃৎপাত্র, গয়না ও মুদ্রাও। ওমান, বাহরাইন এবং মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ইরাকেও এই ধরনের মুদ্রার সন্ধান মেলে। ২০০৭ সালের সার্ভের আগে, সমুদ্রের দুই নটিক্যাল মাইল মারফত এক নটিক্যাল মাইল এলাকায় একটি হাইড্রোগ্রাফিক নিরীক্ষা করা হয়। এর ভিত্তিতেই জলপ্রবাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল।

২০০ বর্গ মিটার এলাকা নির্ধারিত হয় এই তথ্যের বনিয়াদে (গ্রাফ অনুসারে উল্লম্ব এবং অনুভূমিক রেখায় চিত্রিত)। অবশেষে চিহ্নিতকরণের ভিত্তিতে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় সার্ভে হয়। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে বিভাগের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল ডক্টর অলোক ত্রিপাঠী একবার বিবিসিকে বলেছিলেন, 'এর পরে, ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভে বিভাগ আরেকটি খনন পরিচালনা করে। খননকার্যের পর কিছু জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। মনে করা হয়, সেসব ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তাছাড়াও দ্বারকার চারপাশে খননের সময় অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষও পাওয়া যায়।’

তাঁর মতে, '৫০০টিরও বেশি জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এই বস্তুর কার্বন ডেটিং প্রমাণ করে যে, কীভাবে এখানকার সংস্কৃতি পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছিল। অনুসন্ধানের পর যেসব মৃৎপাত্র বা পাথরের সামগ্রী পাওয়া যায়, তা আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে সমুদ্রের যে অংশে স্রোত বেশি, সেখানে মাটির পাত্রের খোঁজ মেলেনি।’

সমুদ্রপৃষ্ঠের ঐতিহাসিক উত্থান-পতন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে, সিএসআইআর-এনআইও'র (CSIR-NIO) প্রাক্তন প্রধান বিজ্ঞানী ড. রাজীব নিগম বলেন, 'প্রায় ১৫,০০০ বছর আগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনকার তুলনায় ১০০ মিটার কম ছিল। এর পরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার স্তর আবার কিছুটা বাড়ে। ৭,০০০ বছর আগে সমুদ্রের স্তর আজকের চেয়ে বেশি ছিল। প্রায় ৩৫০০ বছর আগে এই উচ্চতা আবার হ্রাস পায়। সেই সময় দ্বারকা শহরটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে সমুদ্রের উচ্চতা আবার বাড়তে শুরু করে এবং শহরটি ডুবে যায়।’

দ্বারকার 'সার্চ প্লেস'-এ জোয়ারের আন্ডারকারেন্টের কারণে শুধুমাত্র ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে জলে ডুব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। যেহেতু দেশে এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সংখ্যা খুবই কম, তাই গবেষণাটি ধীরে ধীরে এগিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ (বর্তমানে এএসআই থেকে অবসরপ্রাপ্ত) কে. কে মহম্মদ মনে করেন, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সংস্থান এখনো এ দেশে নেই।

পশ্চিম সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সান্তোরিন (গ্রিস), অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপ 'ডুব শহর'-এর কথা প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা মনে করেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে একটি বিশাল এলাকা তলিয়ে গেছে। এ নিয়ে অনেক কিংবদন্তিও রয়েছে। এমনই একটি বিশ্বাস তামিলনাড়ুর কাছে মহাবালিপুরমেও প্রচলিত। ২০০৪ সালের সুনামির সময় এটির কিছু অংশ সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে বলে জানা যায়।

দ্বারকা গুজরাতের পশ্চিম প্রান্তে আরব সাগরের তীরে অবস্থিত। 'নেচার কমিউনিকেশনস জার্নাল'-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুরাত, কচ্ছ, ভাবনগর এবং ভারুচও আগামী দিনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রভাবিত হতে পারে। এর ফলে জামনগর, দেবভূমি দ্বারকা, পোরবন্দর, জুনাগড়, আমরেলি, নবসারি, ভালসাদ এবং গির সোমনাথ মৃদু থেকে মাঝারি ভাবে আক্রান্ত হতে পারে। তখন হয়তো এই একই ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হবে।

চিত্রঋণ : Robert Melville Grindlay's 'Scenery, Costumes and Architecture chiefly on the Western Side of India'
তথ্যসূত্র - বিবিসি

Powered by Froala Editor